অসুখের পাশে ভালোবাসার ঋণ

আমার বাল্যসখীরা সবাই নিয়মিত দূরে থেকেও সাহস জুগিয়েছে। প্রতিবেশী ভাবি রান্না করে পাঠিয়েছেন। বাড়িওয়ালা ভাই বাচ্চাদের খাওয়া পাঠিয়েছেন। এসব ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। শোধ করতে চাইও না। আজীবন বুকের গহিনে লালন করতে চাই।

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

মোটামুটি এক মাসের যুদ্ধ শেষ হলো। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। কিন্তু প্রিন্সের অফিস সচল ছিল বরাবরের মতোই। প্রতিদিন বাইরে যাচ্ছে–আসছে। সবকিছু যতই ডিজইনফেক্ট করার চেষ্টা করি। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না।

জ্বরে পড়লাম। জ্বর আর মাথাব্যথা। সরকারি হটলাইনে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা অভয় দিলেন। বললেন, এটা ভাইরাস জ্বর, প্যারাসিটামলেই সেরে যাবে। মোবাইলে ব্যবস্থাপত্রও পাঠালেন। জ্বর থেমে থেমে আসে, প্যারাসিটামল খেলে ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পর আবার আসে। আর কিছুই নেই। এভাবেই চলল চার দিন। আমার আর জ্বর এল না। এবার জ্বর এল প্রিন্সের। দুই দিন ভুগল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি কোনো গন্ধ পাচ্ছি না। বুকেও হালকা চাপা ব্যথা।

চিকিৎসকের কাছে গেলাম দুজন। চিকিৎসক দূর থেকে দেখলেন আমাদের। কথা বললেন, স্পর্শ করলেন না। জানতে চাইলেন প্রেসার কত? আমি অবাক হলাম। চিকিৎসকের কাছে আসার আগে কেউ প্রেসার মাপে নাকি! চিকিৎসক প্রেসক্রিপশন লিখতে লাগলেন—অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিহিস্টামিন, প্যারাসিটামল, ভিটামিন, জিংক। কোভিড আর ডেঙ্গু টেস্ট দিলেন, দিলেন বুকের এক্স–রে। সঙ্গে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন।

বেসরকারিভাবে টেস্ট করাতে বেশ খরচ, মাথাপিছু সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সরকারি টেস্ট ফ্রি। কিন্তু তিন দিনেও সিরিয়াল দিতে পারলাম না। বুঝলাম, টাকা খরচ করতেই হবে। ১৫ তারিখে টেস্ট করানোর জন্য নমুনা দিলাম। পরদিনই রেজাল্ট দেওয়ার কথা। কিন্তু জানা গেল না তিন দিনেও। চতুর্থ দিন রাতে ফোনে জানানো হলো, সমস্যা হয়েছে, আমাদের আবার নমুনা দিতে হবে। আবার দিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় প্রিন্সের রেজাল্ট এল পজিটিভ। আমাকে ‘নট পারফর্মড’ মেসেজ দিয়ে আবারও নমুনা দিতে বলা হলো। আবার গেলাম। পরদিন আমার রেজাল্টও এল পজিটিভ।

পজিটিভ হতে পারে, এমন ভাবনা মাথায় ছিল। তারপরও কেমন দমে গেলাম। রাতে খেতে বসেও খেতে পারলাম না। আমার শাশুড়ি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বাচ্চা দুটো ছোট। আমার বয়স্ক মা–ও সঙ্গেই থাকেন। কাকে কোথায় পাঠাব? সিদ্ধান্ত নিলাম, সবাই ঘরেই থাকব।

ঘরে কাজের লোক নেই। না রাঁধলে সবাইকে না খেয়েই থাকতে হবে। রান্না আর খাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক কাজ। আমার যুদ্ধটা তাই আরও বাড়ল।

পঞ্চম দিন থেকে শরীরটা খারাপ হতে শুরু করল। দিন দিন দুর্বল হতে লাগলাম। ডায়রিয়া আর বমি গেল দুই দিন। কয়েক ঘণ্টা পরপর রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপছি, দিনে দুবার ব্লাড প্রেসার মাপছি। আস্তে আস্তে শ্বাসকষ্ট বাড়ল। কথা বলতে কষ্ট হয়। রাতে ঘুম হয় না একদম। অষ্টম দিন রাতে শ্বাসকষ্ট বেশ বেড়ে গেল।

সকালে উঠে সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করলাম। টের পেলাম, বুকের ব্যথাটা আগের চেয়ে অনেক বেশি। দিনে চারবার নেবুলাইজ চলতে লাগল। প্রিন্সেরও কাশি ছিল, তবে শ্বাসকষ্ট হয়নি।

বাচ্চা দুটো আলাদা ঘরে থাকে। এর মধ্যে এক রাতে দুই ভাই খেলতে খেলতে ছোটটার ডান পায়ের আঙুলের ফাঁকে ড্রেসিং টেবিলের কোনা লেগে অনেকখানি ছিলে গেল। দুই হাতে চেপেও রক্ত বন্ধ করতে পারছি না। ওর বাবাকে বললাম, তাড়াতাড়ি পিপিই পরো, গাড়ি বের করো, হাসপাতালে যেতে হবে। ছয়টা সেলাই লাগল বাচ্চাটার। ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা। আর ঘুম এল না। চেয়ার নিয়ে বাচ্চাদের ঘরের কোনায় বসে থাকলাম। আদর যে করব, সে উপায়ও নেই। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

এই সময় অনেক ভালো কিছুও পেয়েছি। আইইডিসিআর থেকে ফোন দিয়ে কয়েকবার কথা বলেছেন চিকিৎসক। প্রিন্সের সহকর্মীরা ওষুধ আর ফল পাঠিয়েছেন। গলির মাথার দোকানদার ফোন দেওয়ামাত্র জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছেন। আমার বাল্যসখীরা সবাই নিয়মিত দূরে থেকেও সাহস জুগিয়েছে। প্রতিবেশী ভাবি রান্না করে পাঠিয়েছেন। বাড়িওয়ালা ভাই বাচ্চাদের খাওয়া পাঠিয়েছেন। এসব ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। শোধ করতে চাইও না। আজীবন বুকের গহিনে লালন করতে চাই।