আমার করোনা টেস্টিং

গাড়ীর দীর্ঘ সারি। ছবি: লেখক
গাড়ীর দীর্ঘ সারি। ছবি: লেখক

সকাল থেকে আমরা এক্সসাইটেড—গত দুদিন থেকে আমাদের এখানে কোভিড-১৯ টেস্ট করছে শুনেছি। শুধু একটা ফার্মেসির মাত্র একটা কেন্দ্রে করছে, তাও ৪৫ মিনিট ড্রাইভ করতে হবে। শুধু একটা ফার্মেসি টেস্ট করছে আর অনলাইনে ফর্ম ফিলাপ করে নিতে হবে বা চিকিৎসকের নোট লাগবে! আমাদের নার্স প্রাকটিশনার আজ টেস্ট করবেন!

আমিও ভাবলাম করি ফর্ম ফিলাপ—শনি বা রোববারে হয়তো করতে পারব। স্লট লিমিটেড। দেখি শনি-রোববারের জন্য এরা স্লট ওপেন করেনি! আজ (৮ এপ্রিল) একই জায়গার পাঁচটা কেন্দ্রের চারটিতেই কোনো স্লট নেই দেখে যখন ভাবছিলাম আশা ছেড়ে দিই, তখনই আমার সুযোগ-সময়মতো একটা স্লট পেলাম। ৪৫ মিনিট যেতে, আসতে ৪৫ মিনিট—তিন ঘণ্টা হিসাবে সময় নিলাম! নিয়েই আমার চালককে (আমার হাজবেন্ড) ফোন দিলাম। ফ্রি হতে পারবে কি না? ওয়েল, ওর তো উপায় নাই! কনফারেন্স নিয়েই আমাকে নিয়ে গেল। অনেক দিন পর মিডটাউনে যাচ্ছি, গাছপালা পাতায় ভরা, ফুল ফুটেছে, কিছু ঝরে গেছে।

কেন্দ্রে যেখান দিয়ে ঢুকব সে রাস্তা বন্ধ করে, শুধু ঢোকার মাত্র একটি রাস্তা রেখেছে! পুলিশ হেভিলি গির্ড দিচ্ছে, হেল্প করছে।

মুখে কোন কথা নয় প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখে চলছেন সবাই। ছবি: লেখক
মুখে কোন কথা নয় প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখে চলছেন সবাই। ছবি: লেখক

এখন বলি, আমি যেখানে কাজ করি, সেখানে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট নেই, তাই আমরাও ছাগলের ৪ নম্বর বাচ্চা। মানে কোনো লক্ষণ না হলে বা সিভিয়ার না হলে নিজেদের টেস্ট করতে পারব না। আর আমরা জানি, অলরেডি আমরা এক্সপোচড! যেখানে যাচ্ছি সেখানে ড্রাইভ থ্রু টেস্ট। মানে আমরা গাড়ি থেকে নামতে পারব না! পুরো সময় গাড়ির কাচ তোলা থাকবে।

যেহেতু পেছনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, আরও মাইলখানেক ড্রাইভ করে পৌঁছালাম মেইন এন্ট্রান্সে! শ খানেক পুলিশ মাইল খানেক জায়গা কভার করছে, কেউ কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে জানাচ্ছেন পরবর্তী নির্দেশনা! গাড়িতে বসেই দেখছি বহুতল গ্যারাজেও কয়েকজন মানুষ!

সারা শহর খালি—দু-একটা গাড়ি দেখেছি যাত্রাপথে! মনে হচ্ছে আশির দশকের ঢাকা শহর! কতক্ষণ পর পর ২-৩ ফুট গাড়ি এগোচ্ছে! মাইলজুড়ে গাড়ি আর গাড়ি! এক ঘণ্টা পরে দেখি মাইল শেষ হয় না! শেষে ঢোকাল সেই বহুতল গ্যারাজে প্ল্যাকার্ডের পর প্ল্যাকার্ড দেখাচ্ছে পরবর্তী রাস্তার। কেউ এসে গাড়ির নম্বর নিচ্ছেন, কেউ আইডি চেক করছেন। আরও ঘণ্টাখানেক পর ইন্সট্রাকশন পেপার দিয়ে বলে, ‘লেখো তোমার ইনফো আর উইন্ডশিল্ডে রাখো। জানালা বন্ধ রাখো।’

ফাইনালি সে স্টেশনে, সোয়াব দিয়ে আবারও বলল কী করতে হবে। বলে দিল, যা-ই করি, জানালা বন্ধ করতে হবে! হাসিমুখে সব ইন্সট্রাকশন! তারপর ধন্যবাদ ঠিকমতো। সোয়াব নেওয়ার জন্য দিল। বলল, কোনায় গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করতে, ফলাফল জানানোর জন্য ফোন দেবে!

১৫ মিনিট আরও রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা! হাজবেন্ড প্ল্যান শুরু করেছে, পজিটিভ হলে কী করবে!
যা-ই হোক অতি আকাঙ্ক্ষিত ফোন পেলাম!
-রেজাল্ট?
- নেগেটিভ!
স্বস্তির হাসি ফুটল মুখে!

শুধু রেজাল্ট দিয়েই থামেনি, সঙ্গে আরও দুমিনিট বলে গেল পরবর্তী করণীয়! যদি কোনো লক্ষণ হয়, কী করতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বলল, ‘আরও একটু দাঁড়াও, আমি আসছি!’
আমাদের সামনের গাড়ি চলে গেছে, ও বলে, ‘তুমি মনে হয় ভুল শুনছো, আসবে না!’
এল সে, হাতে অফিশিয়াল রেজাল্ট দিয়ে গেল!

আমার পুরো প্রক্রিয়া এত গোছানো লেগেছে বলেই লিখছি আজ। কথা না বলেও যে সুন্দর কমিউনিকেট করা যায়, জেনেছি। এরা এমনিতেই কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয় না হোমরাচোমরা মাতব্বর বলে! সবাই তাই ধৈর্য ধরেই লাইন মেনে চলে। ইচ্ছা হলেই চিকিৎসককে বাসায় ডাকতে পারে না। ডাক্তারের গলায় দড়ি দিয়ে বলতে পারে না, ‘চল আমার সঙ্গে রোগী দেখতে।’ বরিস জনসনকেও হাসপাতালে যেতে হয়, চিকিৎসা নিতে (উনি অবশ্য ইংল্যান্ডে, আমরা আমেরিকায়!)

আমার আসলে ইচ্ছা ছিল অভিজ্ঞতা নেওয়ার, কীভাবে ওরা কাজটা করছে!
পুলিশেরা সবাই সার্জিক্যাল মাস্ক পরা!
যাঁরা পেপারওয়ার্ক বা সোয়াব নিয়ে কাজ করছেন, কাজ শেষে হাত ধুয়ে নিচ্ছে, লাইজল দিয়ে টেবিল, বোর্ড ক্লিন করে ফেলছে প্রতিটি ব্যক্তির কাজ করার পর!
কোনো চিকিৎসক নন, নার্সেরা সোয়াব কালেক্ট করছেন।
তাঁরা কী প্রোটেকশন গিয়ার ব্যবহার করছেন?
- সিম্পল গ্লাভস এবং এন-৯৫ মাস্ক পরেছেন।

আমার কাজ হতেই অফিসে জানালাম আমি কখন ফিরছি। পেশেন্ট দেখা শেষ হয়নি। ফিরতে হবে।
ফিরেই জানতে পারলাম আফিশিয়াল রেজাল্ট, আমার গত সপ্তাহের কোভিড সাসপেকটেড পেশেন্টের। ফোন দিলাম তাকে। গলা শুনেই মন ভালো হয়ে গেল।
কেন?

করোনা টেস্টের জন্য এভাবেই সবাই অপেক্ষায় গাড়ীতে। গাড়ীর কাচও খোলা রাখা যাবে না। ছবি: লেখক
করোনা টেস্টের জন্য এভাবেই সবাই অপেক্ষায় গাড়ীতে। গাড়ীর কাচও খোলা রাখা যাবে না। ছবি: লেখক

গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, ও কিওর্ড, ভালো হয়ে গেছে! ওর বউও ভালো হয়েছে! মেয়ের কোনো লক্ষণ নেই!
জানালাম, ওর করোনা হয়েছিল। জানতে চাইল অফিসে আসবে কি না?
বলে দিলাম, আরও দুই সপ্তাহ বাসার বাইরে না যেতে।

তার পরই হলো সমস্যা, অন্য পেশেন্ট দেখি এসেছে। জোরে একটা শ্বাসও নিতে পারছে না! জ্বর নেই। অ্যাজমার রোগী—এক্সরে করলাম, নেবুলাইজ দিলাম। তার পরও দেখে ভালো মনে হলো না। বললাম, ‘তোমার হসপিটালে যাওয়া উচিত যদিও অক্সিজেনেশন ভালো। নিউমোনিয়া মনে হচ্ছে।’ হাসপাতালে ফোন দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম কোভিড টেস্ট আর পরবর্তী ম্যানেজমেন্টের জন্য!
আমার দিনরাত্রি এমনই কাটে—মন ভালো হয়, পেশেন্টদের অবস্থার উন্নতি দেখলে। খারাপ হয়, খারাপ হলে।
আমি কি ব্যবহার করি ক্লিনিকে?

গ্লাভস আর এন-৯৫ মাস্ক মাত্র। সেটাও সপ্তাহখানেক ধরে একই মাস্ক, নতুন কবে পাব জানি না। লাইজল দিয়ে ক্লিন করে নিতে বলছে!
স্টেথিসকোপ ও প্রথমে লাইজল দিচ্ছি, তারপর ধুয়ে নিচ্ছি।
সার কথা—কোভিডে সবাই মরবে না!

কোভিড বা করোনা হলেই হাসপাতালে থাকতে হবে না, যদি রোগী বিশ্বস্ততার সঙ্গে নিজেকে ঘরে আটকে রাখেন, চিকিৎসকের পরামর্শ মানেন।
আর যদি নিজেদের কথা না ভাবেন বা মানুষের প্রতি সম্মান না দেখান, গায়ের জোরে চলতে চান, মৃত্যু ঠেকাবার কথা ভুলে যেতে হবে!
সবাই নিজ দায়িত্ব পালন করুন! ঘরে থাকুন। সুস্থ থাকুন। সবাইকে অসুস্থ বানিয়ে, চিকিৎসককে দোষ দেওয়া বন্ধ করুন! চিকিৎসক ততটুকুই ভালো, যতটা আপনি।
অবস্থা খারাপ হলেই শুধু চিকিৎসকের কাছে যান বা হাসপাতালে যান! জ্বর, সর্দি হলে দু সপ্তাহ বাসায় থেকেই জ্বর আর ঠান্ডার ওষুধ খান। করোনার ৯০ শতাংশ প্রোটেকশন আপনাদেরই হাতে!