আশঙ্কা থাকবে, তবু জীবন

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

প্রতীকী ছবি

জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আমার মামণির জ্বর আর কাশি দেখা দিল। টেস্ট করতে দেওয়ার পর ফোনে খবর এল, মামনির কোভিড পজিটিভ। আমরা চারজন মামণির ঘরে বসে গল্প করছিলাম। নিমেষেই মুখের হাসি উধাও।

মামণিকে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে আমরা অন্য ঘরে চলে এলাম। আমার চিকিৎসক স্ত্রী তাসনিম সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, মামণির সামনে মন খারাপ করব না, বরং তাকে সাহস দেব। মামণি সন্ধ্যায় আমাদের ডেকে কোথায় ফ্ল্যাট আর জমির কাগজপত্র আছে, কোন গহনা কাকে দিতে হবে, এসব বলতে থাকল। তখন কি নিজেদের সামলে রাখা যায়?

মামণি আলাদা ঘরে থাকলেও দরজা লাগাতে দিইনি। আমরা ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম, অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করতাম, তাসনিম গিয়ে স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক–পিঠ চেক করত, বোন উপ্তি গিয়ে গল্প করত। আমরা তাকে একাকিত্ব অনুভব করতে দিইনি। আমরা অবশ্য মাস্ক পরেই যেতাম, ফেসশিল্ড ব্যবহার করতাম, ফিরে এসে নিজেদের স্যানিটাইজ করতাম। রাতে ঘুমানোর পর অন্তত দুবার করে দেখতে যেতাম।

হঠাৎ করে ঈদের আগের রাতে মামণির অক্সিজেন স্যাচুরেশন একবার ৯১, আরেকবার ৮৬ হয়ে যায়। আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমার স্ত্রীর পুরোনো কর্মস্থল ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু সঙ্গে কে যাবে? উপ্তি যেতে চায়, কিন্তু তাকে না করে দিই। তার পক্ষে এতটা কষ্ট করা সম্ভব নয়। আমিই মামণির সঙ্গে থাকব। তাসনিমকে বলি ভর্তি করিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু সে বলে, তার থাকাটা জরুরি, নইলে পরিস্থিতি পাল্টালে আমি একা সামলাতে পারব না। তাসনিম তার সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত কেবিনের ব্যবস্থা করে ফেলল।

দেখতে দেখতে ঈদ চলে এল। একই কেবিনে আমি, মামণি আর তাসনিম। বাইরের আকাশ কাঁদছে। আমাদের ভেতরটাও কাঁদছে। গোসল হয়নি, খাওয়া হয়নি, কিন্তু দুপুর হয়ে গেছে। হাসপাতালে বাইরের খাবার নিয়ে যাওয়া নিষেধ। কিছু আনতেও পারছি না। কনসালট্যান্ট ডাক্তার এসে মামণিকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘আপনি বেশ ভালো আছেন, নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।’

এরই মধ্যে মামণির ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়ল। প্রতিদিন চলল টেস্টের পরে টেস্ট, গাদা গাদা ওষুধ আর ইনজেকশন। দেখতে দেখতে নিজেই দিশেহারা হয়ে যেতাম। মামণিকে এতটা অসহায় আমি কোনো দিন দেখিনি। এতই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে নামাজের পর আর বসে থাকতে পারেন না।

মামণি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাঁর ফোনকলগুলো আমিই রিসিভ করেছি। আমি কেন তার ফোন ধরছি, কেন তার হাত দিয়ে ধরে তুলছি—এসব কথাও অনেকেই বলেছেন। আমার ভালোর জন্যই বলেছেন। মামণির করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও একদিন আমি লিফটে ওঠার পর এক প্রতিবেশী আমার সালামের উত্তর না দিয়ে দ্রুত নেমে গেলেন। অন্যদিন আরেক প্রতিবেশীর স্ত্রী আমি লিফটে ওঠার পর লিফট থেকে নেমে যান।

মামণির সঙ্গে একই কেবিনে আমরা সাত দিন চব্বিশটা ঘণ্টা কাটিয়েছি। মামণির নেগেটিভ হওয়ার পর আমরাও তিনজনই টেস্ট করিয়েছি। আল্লাহর রহমতে সবাই নেগেটিভ। করোনা রোগীর সঙ্গে বসবাস করলেই করোনা হয় না। আমরা আসলে এখনো মননে বেড়ে উঠিনি। আশঙ্কা আছে, আশঙ্কা থাকবে। তাই ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে চলতে হবে। করোনা রোগীকে সাহস জোগাতে হবে। একা একা বেঁচে মানবজন্মের কোন সার্থকতা আসবে!