উহান থেকে শিবচর: করোনার বাংলাদেশ যাত্রা

লকডাউন হওয়া মিরপুরের টোলারবাগ এলাকায় পুলিশের সতর্ক উপস্থিতি
ফাইল ছবি

শুরুতে এটি ছিল ‘রহস্যময় ভাইরাস’, যার সঙ্গে ২০০২ সালে প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া ‘সিভিয়ার অ্যাকুয়েট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স)’ ভাইরাসের মিল ছিল। গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে এই নতুন করোনাভাইরাসে প্রথম মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে উহানে লকডাউন জারি করা হয়। শুরুতে চীন বলেছিল, ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষ নয়, প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে।

চীনের এই ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন দেশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। চীনের বাইরে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন থাইল্যান্ডে, গত ১৩ জানুয়ারি। পরে বিভিন্ন দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগের নামকরণ করে ‘কোভিড-১৯’। করোনা থেকে ‘কো’, ভাইরাস থেকে ‘ভি’, ‘ডিজিজ’ বা ‘রোগ’ থেকে ‘ডি’ এবং প্রাদুর্ভাবের সময় ‘১৯’ নিয়ে এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ করা হয়।

করোনাভাইরাস শনাক্তে বাংলাদেশও শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যদিও এই স্ক্রিনিং নিয়েও বিতর্ক ছিল।
বেশ কিছু দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কাটানোর পর গত ৮ মার্চ সরকার প্রথম দেশে করোনা শনাক্তের কথা জানায়। সেদিন তিনজনের করোনা শনাক্তের কথা জানানো হয়, যাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন ইতালিপ্রবাসী আর একজন ছিলেন প্রবাসীর পরিবারের সদস্য। তাঁদের দুজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জের।

মাদারীপুরের শিবচরে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ১৪ মার্চ। করোনা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯ মার্চ দেশের প্রথম ‘কন্টেইনমেন্ট’ (নিয়ন্ত্রিত এলাকা) ঘোষণা করা হয় শিবচর উপজেলাকে। কার্যত অবরুদ্ধ বা লকডাউন হয়ে যায় পুরো শিবচর উপজেলা। উপজেলার রাস্তাঘাট, হাটবাজার জনশূন্য হয়ে পড়ে।

দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। আর করোনায় মিরপুরের উত্তর টোলারবাগের দুই বাসিন্দা মারা যান ২১ ও ২২ মার্চ। এরপর ২৩ মার্চ টোলারবাগকে সংক্রমণের হটস্পট (অতি ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। লকডাউন ঘোষণার পর টোলারবাগে ঢোকা ও বেরোনোর পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।

করোনা-আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় পুরো শিবচর উপজেলাকে লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন। উপজেলার সব প্রবেশপথ বাঁশ ও গাছের গুঁড়ি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকায়
ফাইল ছবি

টোলারবাগ এলাকার লকডাউন সফল করার জন্য পুলিশ, সিটি করপোরেশন উদ্যোগী ছিল। পাশাপাশি স্থানীয় সাংসদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, বাড়ি ও ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতিসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও যুক্ত হয়েছিলেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা এলাকায় ব্যাপকভাবে কনট্যাক্ট ট্রেসিং বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছিলেন।

দেশে সংক্রমণ শনাক্তের প্রায় এক মাসের মাথায় (৫ এপ্রিল) আইইডিসিআর পাঁচটি ক্লাস্টার (কম দূরত্বের মধ্যে অনেক রোগী) চিহ্নিত করেছিল। এর দুটি ছিল ঢাকায়। একটি মিরপুরের টোলারবাগ, অন্যটি বাসাবো। মাদারীপুরে শিবচর, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর ও নারায়ণগঞ্জ।

ক্লাস্টারঘোষিত নারায়ণগঞ্জে এপ্রিলের ৫ তারিখে শনাক্ত হন ১১ জন। একসময় নারায়ণগঞ্জ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রে (এপিসেন্টার) পরিণত হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে ৮ এপ্রিল পুরো জেলা লকডাউন করা হয়। কিন্তু সেটাও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। লকডাউনের মধ্যেই পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রলার, বাস, অ্যাম্বুলেন্স ও মাইক্রোবাসে চড়ে শত শত মানুষ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসরকারি প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত করা হয়। সাত দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। ৬৬ দিন ছুটি থাকার পর ৩১ মে সীমিত আকারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়।

দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ ঝুঁকিতে দেশ

দেশে করোনার সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকে লোকজনের স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা বেড়ে যায়। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি বেশ খারাপ ছিল। সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা কমে আসে। সরকারি মহল থেকে শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে আলোচনা শুরু হয়।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলেন, দেশে করোনার টেস্টিং (পরীক্ষা), ট্রেসিং (আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা), আইসোলেশন (রোগীদের বিচ্ছিন্ন রাখা)—এগুলো যথাযথভাবে হয়নি। অন্যদিকে অনেকে পরীক্ষার বাইরে রয়ে গেছেন, অনেকে উপসর্গবিহীন। এসবের ফলে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

দেশে করোনা শনাক্তের শুরু থেকেই পরীক্ষা কম হওয়া নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা দৈনিক কমপক্ষে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার কথা বলছেন। কিন্তু সরকার উল্টো পথেই হাঁটে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রও উঠে আসছে না। অনেক আলোচনা ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর সরকার ৫ ডিসেম্বর দেশের ১০টি জেলায় করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করে। বর্তমানে ৩৮টি জেলা ও ২টি উপজেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে।

শীতের আগমনী বার্তার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দৈনিক দুই হাজারের বেশি শনাক্ত হচ্ছিল। সংক্রমণ শনাক্তের হারও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তবে ১০ ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ শনাক্তের হার ও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের আশপাশে থাকছে।

এখন সবাই অপেক্ষায় রয়েছে করোনার টিকার। সরকার ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে। আগামী জানুয়ারির যেকোনো সময় যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি টিকা বাংলাদেশে আসবে বলে জানিয়েছে সরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির অন্যতম সদস্য ও জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’—করোনাভাইরাস বিষয়টি স্পষ্ট করে শিখিয়েছে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, ভিড় এড়ানোর মতো বেশ কিছু সংযমী আচরণ শিখিয়েছে করোনা। আর স্বাস্থ্য বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একক দায়িত্ব নয়, এটিও বুঝিয়েছে। জনস্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ২০২০ সালে পাওয়া শিক্ষা ২০২১ সালে জোরালোভাবে কাজে লাগাতে হবে।