এক মাসে রাজধানীতে রোগী বেড়েছে ২০%

দেশে করোনা সংক্রমণ

  • মোট শনাক্ত (৮ মার্চ–২৯ অক্টো.) ৪,০৪,৭৬০

  • মোট সুস্থ ৩,২১,২৮১

  • মোট মৃত্যু ৫,৮৮৬

২৪ ঘণ্টার চিত্র

  • নমুনা পরীক্ষা ১৪,২৬৮

  • শনাক্ত রোগী ১,৬৮১
    মৃত্যু ২৫

  • সুস্থ ১,৫৪৮

সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

রাজধানীতে করোনার সংক্রমণ বেশি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে অনেকেই উদাসীন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সোয়ারীঘাট এলাকায়
ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশে করোনা মহামারির শুরু থেকেই রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণ বেশি। এখনো সে ধারা অব্যাহত আছে। গত এক মাসে নতুন রোগী বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি রাজধানীতে। এ সময়ে ঢাকায় নতুন রোগী বেড়েছে ২০ শতাংশ। অবশ্য রাজধানীতে করোনার সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষাও বেশি হচ্ছে। এখন সারা দেশে মোট যে পরিমাণ নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার ৭০ শতাংশই ঢাকার ভেতরে।

দেশে এখন করোনা সংক্রমণের অষ্টম মাস চলছে। মাস দুয়েক ধরে পরীক্ষার তুলনায় নতুন রোগী ও সংক্রমণ শনাক্তের হার কমেছে। এখন সে হার ১১ শতাংশের মতো। তবে দেশের সব জায়গায় রোগী শনাক্তের হার সমান নয়। সাতটি জেলায় এখন রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা নিশ্চিত করে সরকার। ক্রমে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এখন সংক্রমণ কমতে থাকলেও আসন্ন শীতে তা আবার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে সরকার। দুদিন ধরে রোগী শনাক্তের হার সামান্য বাড়তে দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, যদি আগামী দুই সপ্তাহে শনাক্তের হার বাড়তে থাকে, তাহলে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বলে ধরা যাবে।

দেশে এখন পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১১%। কিন্তু সাতটি জেলায় এখনো এই হার ২০ শতাংশের ওপরে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪ হাজার ৭৬০ জন। এর মধ্যে গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৮১ জন। এ পর্যন্ত মারা গেছে ৫ হাজার ৮৮৬ জন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৫ জন। আর এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৮১ জন।

দেশে ইতিমধ্যে যাঁদের সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে, তাঁদের এলাকাভিত্তিক হিসাব প্রকাশ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তবে তাদের হিসাবে সব রোগীর এলাকাভিত্তিক তথ্য নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় তিন লাখ মানুষের এলাকাভিত্তিক তথ্য দিয়েছে তারা।

আইইডিসিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আগের তুলনায় গত এক মাসে (২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৯ অক্টোবর) রাজধানীতে নতুন রোগী বৃদ্ধির হার ২০ দশমিক ১৩ শতাংশ। দেশের বেশির ভাগ জেলায় নতুন রোগী বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটে নতুন রোগী বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। চট্টগ্রাম জেলায় এই হার ১২ শতাংশ আর সিলেটে ১১ শতাংশ। এ ছাড়া উত্তরের জেলা নীলফামারী, ঠাকুগাঁও ও পঞ্চগড়ে এক মাসে রোগী বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে গত এক মাসের ব্যবধানে রাজধানীতে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে নতুন রোগী বেড়েছে সাড়ে তিন হাজার, যা দেশের অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে বেশি। সংস্থাটির হিসাবে গত সোমবার পর্যন্ত রাজধানীর প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ২৬ হাজার ৫৯ জনের দেহে কোভিড–১৯ শনাক্ত হয়েছে।

আইইডিসিআরের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে গতকাল পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৫১ জনের তথ্য আছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর বেশি।

রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই এখন জীবনযাত্রা অনেকটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মাস্ক পরা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব বাড়ছে। কাঁচাবাজার শুধু নয়, অফিস ও ব্যাংকপাড়াতেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যাচ্ছে না। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো সরকারি বিশেষ উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়। তাই বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সংক্রমণ থেমে নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে প্রতিদিন কত পরীক্ষা হচ্ছে এবং কতজন রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তার হিসাব প্রকাশ করা হচ্ছে না। যার ফলে এখানে এখন শনাক্তের হার কত, তা জানা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে এখন রোগী শনাক্তের হার ১০–১১ শতাংশ। দুদিন ধরে সেটা বাড়ছে। সপ্তাহ দুয়েক এটি বাড়লে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা থাকবে। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় শনাক্তের হার বেশি, সেখানে কেন বেশি তা খতিয়ে দেখা দরকার।

৭ জেলায় শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি

দেশে মে মাসের শেষ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এখন সেটা কমে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু ৭ জেলায় এখনো শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি। প্রথম আলোর ৬৩টি জেলার প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে গত এক সপ্তাহের (২২ থেকে ২৮ অক্টোবর) মোট পরীক্ষা ও শনাক্ত রোগীর সংখ্যার তথ্য নিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, মুন্সিগঞ্জে এই সপ্তাহে ১৯০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৫ জন। রোগী শনাক্তের হার প্রায় ২৯ শতাংশ।

মুন্সিগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে মুন্সিগঞ্জে নতুন রোগী কমেছিল। তবে গত সপ্তাহখানেক ধরে নতুন রোগী বাড়ছে। তিনি বলেন, শনাক্তের হার বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে আগের মতো বেশিসংখ্যক মানুষ এখন পরীক্ষা করাতে আসেন না। এখন যাঁদের লক্ষণ উপসর্গ জোরালো, তাঁরাই আসছেন।

এ ছাড়া সুনামগঞ্জ, নড়াইল, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠিতে পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের বেশি।

এর বাইরে ২২টি জেলায় শনাক্তের হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। বাকি ৩৪টি জেলায় গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে ছিল। এর মধ্যে বাগেরহাট, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ সময় নতুন কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি।

দেশে গতকাল পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জেলাগুলোর মধ্যে মৃত্যুর হার এখনো সবচেয়ে বেশি চাঁদপুরে (৩.৩২%)।

বৈশ্বিক চিত্র

এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিশে মানুষ আক্রান্ত ও মারা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এরপরই আছে ভারত। এ দুই দেশে এখনো নতুন রোগী বাড়ছে। ৯ মাসেও দেশ দুটিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। চীনের পর সংক্রমণ বেশি দেখা গিয়েছিল ইউরোপে। সেখানকার দেশগুলো প্রথম তিন থেকে চার মাসের মাথায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুই–তিন মাস নিয়ন্ত্রণে থাকার পর ইউরোপে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এখন নতুন রোগী বেশি বাড়ছে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত। গত এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বেড়েছে এমন ১২টি দেশের আটটিই ইউরোপের। সেগুলো হলো ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চেচনিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানি ও বেলজিয়াম। এ ছাড়া এই তালিকায় আছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।

ইউরোপের মতো বাংলাদেশেও শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা বলছে সরকার। আইইডিসিআরের পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগের চেয়ে সংক্রমণ কমেছে। কিন্তু কমার হার একটি পর্যায়ে এসে থমকে গেছে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ বেশি। এখন সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে যেকোনো সময় তা আবার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধিরা]