এবার কি আমরা ঠেকে শিখব?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যুক্তরাষ্ট্র করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের কাছে চিকিৎসা সরঞ্জামের অনুরোধ করেছে, এই খবরে কোনো কোনো মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ নিজেই একটি ‘নাই নাই’-এর দেশ, সে কী করে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশটিকে সাহায্য করবে?

কিন্তু কথাটা সত্যি। এটা আমার অনুমান নয়, আমি জেনেই বলছি। করোনা সংকট মোকাবিলায় সাহায্য হয় এমন ২৫ ধরনের সাজসরঞ্জাম চেয়ে বাংলাদেশের কাছে জরুরি অনুরোধ পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়। অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাতে সক্ষম। যেমন, সার্জিক্যাল ও নিত্যব্যবহার্য মাস্ক, দস্তানা ও অ্যাপ্রোন। চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই নামে পরিচিত এসব সরঞ্জাম দ্রুত তৈরি ও রপ্তানিতে তার চেয়ে অধিক সক্ষম আর কে রয়েছে?

শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের যেখানে যার কাছে অতিরিক্ত পিপিই রয়েছে, তার কাছে এসব উপকরণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। শুধু যে ফেডারেল সরকার তা–ই নয়, অঙ্গরাজ্য পর্যায়েও তোড়জোড় চলছে কোত্থেকে কীভাবে এসব উপকরণ সংগ্রহ করা যায়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে করোনা রোগীর সংখ্যা বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। যথাসময়ে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি, ফলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসক-নার্সরা সামান্য মাস্কের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। অবস্থার সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন চড়া দাম দিয়ে বিশ্বের যেখানে যা পাওয়া যায়, কিনে গুদামে তুলতে হচ্ছে।

ঘটনাটা সামান্য, কিন্তু এর ভেতর যে শিক্ষা নিহিত, তা নেহাত সামান্য নয়। করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯-এর উৎস চীন থেকে হলেও তা সব সীমান্তের বাধা অগ্রাহ্য করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো দেশই আর এখন এর সংক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। এই জাতীয় সমস্যাকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ‘প্রবলেমস উইদাউট পাসপোর্টস’ অর্থাৎ, ছাড়পত্রবিহীন সমস্যা নামে অভিহিত করেছিলেন। ২০০৯ সালে এক ভাষণে তিনি এই জাতীয় সমস্যার উদাহরণ হিসেবে পরিবেশ সংকট, বায়ুদূষণ, সমুদ্রে মাত্রাতিরিক্ত মাছচাষ, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ ও মেরুকরণ প্রবণতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। পরে সংক্রামক ব্যাধিও এই তালিকায় যুক্ত করেছিলেন। তাঁর মোদ্দা বক্তব্য ছিল, এই সমস্যাগুলো কোনো এক দেশের নয়, কোনো এক দেশের পক্ষে সম্ভবও নয় এসব সমস্যার সমাধান। তাদের সমাধানের জন্য দরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রয়োজন ‘সীমান্ত চিহ্নবিহীন এক নীলনকশা’, তাঁর কথায় ‘আ ব্লুপ্রিন্ট উইদাউট বর্ডারস’।

গত এক শ-সোয়া শ বছর পৃথিবী অনেক বড় বড় সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণের শিকার হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহাপ্রলয়ংকরী স্প্যানিশ ফ্লুর কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। সে ঘটনার তিন দশক পর, ১৯৫৬-৫৮ সালের এশিয়ান ফ্লুর কথা ভাবুন। প্রধানত এশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ সেই মহামারিতে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৬৮-এর ফ্লু সংক্রমণে মারা যায় প্রায় ১০ লাখ, যার প্রকোপ থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, ভারত-বাংলাদেশও রেহাই পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা, সার্স ও মার্স সংক্রামক ব্যাধিতে মৃত্যুর সংখ্যা সীমিত হলেও পৃথিবীর একাধিক দেশ তাতে আক্রান্ত হয়।

এত সব অভিজ্ঞতার পরও পরবর্তী সংক্রামক ব্যাধির জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি পৃথিবীর কোনো দেশই গ্রহণ করেনি। এর জন্য যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য, সে বিষয়টিও পর্যাপ্ত মনোযোগ পায়নি। কিন্তু এখন, দাবানলের মতো করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে দেখে পৃথিবীর কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসা শুরু করেছেন। দেয়াল দিয়ে অবৈধ অভিবাসন হয়তো ঠেকানো যায়, কিন্তু ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যায় না। পৃথিবীর মানুষ আমরা এখন একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছি যে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একা একা এই সংকট আমরা কাটাতে পারব না। মুখে স্বীকার না করলেও তাঁদের গৃহীত ব্যবস্থা থেকে বোঝা যায় তাঁরা এখন ঠেকে শিখেছেন।

গত সপ্তাহে বিশ্বের ১৪টি দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলো এক যৌথ বিবৃতিতে মত রেখেছে, চলতি ও ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের মতো সংকট এড়াতে পৃথিবীর সব দেশকেই এক হয়ে কাজ করতে হবে। শুধু ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে নয়, বৈজ্ঞানিক তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও। বিপদ এড়াতে হলে সবার আগে চাই সঠিক তথ্য। চীনের মতো কোনো কোনো দেশ নেতিবাচক প্রচারের আশঙ্কায় করোনা–সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিচ্ছে না, এমন অভিযোগ উঠেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দ্রুত, নির্ভরযোগ্য ও স্বচ্ছ’ তথ্য বিনিময় ছাড়া এই সংকটের মোকাবিলা করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই মুহূর্তে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, করোনাভাইরাসের উদাহরণে তার একটি চমৎকার চিত্র তুলে ধরেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নগেয়ার উডস ও দাতব্য সংস্থা কালেকটিভ হেলথের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজায়ি বাতনিজি। এক যৌথ নিবন্ধে তাঁরা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সবচেয়ে বেশি দরকার কারা এই ব্যাধিতে আক্রান্ত তা নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা বা টেস্টিং। কিন্তু এর জন্য যে সোয়াব (swab) চাই, তার প্রধান উৎপাদক কোপান নামের একটি ইতালীয় কোম্পানি। এই ভাইরাসের রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য যে মিশ্রণ বা রিএজেন্ট প্রয়োজন, তার মুখ্য উৎপাদক কিয়াজেন নামক একটি জার্মান সংস্থা। আর যে ভেন্টিলেটরের অভাব পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ অনুভব করছে, তার অধিকাংশই আসে চীন ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকে। এই অবস্থায় উৎপাদক দেশগুলো যদি বলে বসে নিজেদের প্রয়োজন না মেটা পর্যন্ত অন্য কাউকে একটাও জিনিস দেবে না, তাহলে বাকি সবাইকে বিপদে পড়তে হবে। বিশেষজ্ঞ দুজন প্রস্তাব করেছেন, এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়, ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। কার কী উপকরণ রয়েছে, কোথায় কী উদ্বৃত্ত, সে হিসাব নিয়ে প্রয়োজনমতো তার বণ্টনের ব্যবস্থা। পাশাপাশি এসব উপকরণের উৎপাদন ও বণ্টনের আন্তর্জাতিক পরিকাঠামো নির্মাণ। সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি কার্যকর ভ্যাকসিন বা টিকা। এখানেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

অনুমান করি, টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখবে ধনী দেশগুলো। কিন্তু সে টিকার ব্যবহার যাতে বিশ্বের সর্বত্র, বিশেষ করে গরিব দেশগুলোয়, সম্ভব হয়, তার নিশ্চয়তার বিধান করা না গেলে করোনার মতো ভাইরাসের ছোবল থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। গুটিবসন্তের উদাহরণ থেকে আমরা জানি, ধনী দেশগুলো যার যার মতো নিজেদের জন্য গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই সে সমস্যার সমাধান করেছিল। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাবে অনুন্নত দেশগুলো সে সুবিধা থেকে বাদ থেকে গিয়েছিল। ফলে অনুন্নত দেশগুলোর হাত ধরে সেই গুটিবসন্ত ফের শিল্পোন্নত দেশগুলোয় ফের ফিরে এসেছিল। পরে সত্তর ও আশির দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে বড় ধরনের সমন্বিত আন্তর্জাতিক উদ্যোগের ফলেই গুটিবসন্ত নির্মূল সম্ভব হয়েছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে বর্ণ ও ধর্মভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদের ব্যাপক উত্থান আমরা দেখেছি, তার প্রভাবে বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিক সংহতি পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিকতাবাদের বদলে যাঁর যাঁর নিজের কথা ভাবুন। সেটাই হবে প্রকৃত দেশপ্রেম। কথাটা যে ঠিক নয়, করোনাভাইরাসের বিপর্যয় থেকে আমরা তা শিখেছি। ট্রাম্প কী শিখেছেন, কতটা শিখেছেন, তা অবশ্য বলতে পারব না।

এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আজ অথবা কাল করোনা সংক্রমণের সংকট থেকে আমরা মুক্তি পাব। কিন্তু এই বিপর্যয় থেকে যদি সঠিক শিক্ষা নিতে আমরা ব্যর্থ হই, আরেক বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক