করোনা ইউনিটে অনিয়মের অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতে অক্সিজেন বিতরণ

করোনা ইউনিটের সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে পুলিশ সদস্যকে স্লিপ দেখাচ্ছেন স্বজনেরা। হাসপাতালের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় পুলিশের উপস্থিতিতে আজ অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করা হয়েছে।
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে অক্সিজেন নিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় পুলিশের উপস্থিতিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিতরণ করা হয়েছে। আজ বুধবার সকালে করোনা ইউনিটের সামনে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখে সিলিন্ডারবাহী ট্রাক থেকেই রোগীর স্বজনদের সিলিন্ডার দেওয়া হয়।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে নগরের পলাশপুর এলাকার রুনা বেগম নামের এক নারী এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি হন। এরপর রুনা বেগমের ছেলে ও স্বজনেরা তিন ঘণ্টা ঘুরেও অক্সিজেন সিলিন্ডার পাননি। এরপর বিকেলে যখন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা হয়, তখন ওই নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রুনু বেগমের ছেলে আল আমিন অভিযোগ করে বলেন, সিলিন্ডার চাইতে গেলে হাসপাতালের এক কর্মচারী তাঁদের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেন।

নতুন রোগীকে ওয়ার্ডে নেওয়া, অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া, খালি সিলিন্ডার পাল্টে দেওয়া, শয্যার আশপাশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা, সুস্থ রোগীর ছাড়পত্র দেওয়াসহ সবকিছুতেই সংশ্লিষ্টদের অর্থ দিতে হয় বলে জানা গেছে। এমনকি করোনা ওয়ার্ডে মারা গেলে ওই লাশের কফিন ঘিরেও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ‘ব্যবসা’ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩০০ শয্যার করোনা ইউনিটে ৫৯৩টি ছোট এবং ৫০টি বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। এসব সিলিন্ডার প্রতিদিন দুবার করে রিফিল (ভর্তি) করা হচ্ছে; পাশাপাশি ১০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি তরল অক্সিজেন সিলিন্ডারও আছে। এটি দিয়ে হাসপাতালের ১২৮টি শয্যায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে।

তবে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, তাঁরা চাহিদামতো অক্সিজেন পাচ্ছেন না। আবার কোনো কোনো রোগীর স্বজনেরা ৩-৪টি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করে রাখছেন। সিলিন্ডার পেতে অনেকেরই টাকা গুনতে হচ্ছে। একইভাবে হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের টাকা না দিলে শয্যাও পাওয়া যাচ্ছে না।

‘বকশিশের’ নামে বিভিন্নভাবে রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলে জানান রোগীর স্বজনেরা। নতুন রোগীকে ওয়ার্ডে নেওয়া, অক্সিজেন সিলিন্ডার দেওয়া, খালি সিলিন্ডার পাল্টে দেওয়া, শয্যার আশপাশ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা, সুস্থ রোগীর ছাড়পত্র দেওয়াসহ সবকিছুতেই সংশ্লিষ্টদের অর্থ দিতে হয় বলে জানা গেছে। এমনকি করোনা ওয়ার্ডে মারা গেলে ওই লাশের কফিন ঘিরেও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা ‘ব্যবসা’ করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে রুনা বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর লাশের পাশে স্বজনদের আহাজারি। ছবিটি মঙ্গলবার বিকেলে করোনা ইউনিট ভবনের সামনে থেকে তোলা।
ছবি: প্রথম আলো।
বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ট্রলিতে করে দোতলায় নিতে ৪০০ টাকা, সেখানে শয্যা পেতে ৩০০ টাকা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন পেতে ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। এরপর ১১ জুলাই বাবা মারা যাওয়ার পর মরদেহ আনার সময় সেখানের কর্মচারীরা বকশিশ চান। এরপর সেখানেও ৫০০ টাকা দিয়েছি।
কৌশিক ইসলাম , করোনায় মারা যাওয়া রোগীর ছেলে

নাম না প্রকাশের শর্তে ভুক্তভোগীরা বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে মুমূর্ষু রোগীকে করোনা ওয়ার্ডের সামনে নিয়ে গেলে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। টিকিট কাটাসহ ভর্তিপ্রক্রিয়ায় অন্তত ৪০ মিনিট চলে যায়। এরপর রোগীকে স্ট্রেচারে করে করোনা ওয়ার্ডে নিতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সহায়তা লাগে। এখানেও তাঁদের টাকা দিতে হয়। আবার শয্যার তুলনায় রোগী বেশি হওয়ায় শয্যা ম্যানেজ করার নামেও অর্থ হাতিয়ে নেন তাঁরা।

সম্প্রতি করোনায় মারা যাওয়া উজিরপুর উপজেলার শাহজাহান মোল্লার ছেলে কৌশিক ইসলাম অভিযোগ করেন বলেন, ‘বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার পর ট্রলিতে করে দোতলায় নিতে ৪০০ টাকা, সেখানে শয্যা পেতে ৩০০ টাকা, সেন্ট্রাল অক্সিজেন পেতে ৪০০ টাকা দিতে হয়েছে। এরপর ১১ জুলাই বাবা মারা যাওয়ার পর মরদেহ আনার সময় সেখানের কর্মচারীরা বকশিশ চান। এরপর সেখানেও ৫০০ টাকা দিয়েছি।’

হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, হাসপাতাল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ করোনা ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও সংক্রমণের ভয়ে ওই ইউনিটে খুব একটা যান না। এই সুযোগে কয়েকজন ওয়ার্ড মাস্টার, কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবক মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এই অনিয়ম চালাচ্ছেন।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। চাহিদার চেয়ে বেশি অক্সিজেন সরবরাহ রয়েছে। ইতিমধ্যে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তবে হাসপাতালে চিকিৎসকসহ জনবলসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। এ জন্য রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাচ্ছে না। করোনা ইউনিট চালুর পর থেকে এখানে আলাদা কোনো চিকিৎসক দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক দিয়েই করোনা রোগীদের চিকিৎসা চলছে। কেউ অনিয়ম করলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

তাঁদের সাধারণ শয্যায় স্থানান্তরের জন্য বলা হলে ওই তিন রোগী শয্যা ছাড়তে রাজি হননি। পরে ওই দিন রাতেই সেখানে পুলিশ পাঠানো হলেও ওই রোগীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁরা তখন শয্যা ছাড়েননি।
সাইফুল ইসলাম, পরিচালক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

আইসিইউ শয্যা দখল

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর বাবা করোনায় মুমূর্ষু অবস্থায় গত ২১ জুলাই সকালে এই হাসপাতালে আসেন। তাঁর আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন থাকলেও ওই সময় কোনো শয্যা খালি ছিল না। ওই দিন আইসিইউ ইউনিটে ভর্তি একজন রোগীর অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ ওপরে থাকায় তিনি অনেকটা সুস্থ ছিলেন। এ জন্য ওই দিন সকালেই চিকিৎসকেরা তাঁকে আইসিইউ শয্যা ছেড়ে সাধারণ শয্যায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ওই রোগী ও তাঁর স্বজনেরা কিছুতেই শয্যা ছাড়তে রাজি ছিলেন না; বরং ওই রোগীর স্বজনেরা হাসপাতালের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে শয্যাটি ধরে রাখেন। পরে চিকিৎসকদের হস্তক্ষেপে বেলা আড়াইটার দিকে ওই রোগী শয্যা ছেড়ে দিলে মুমূর্ষু ওই রোগী আইসিইউ শয্যা পান।

আইসিইউ শয্যা দখলে রাখার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও প্রভাবশালীদের দোহাই দিয়ে তুলনামূলকভাবে কিছুটা সুস্থ রোগী আইসিইউ শয্যা দখলে রেখেছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি এসব ব্যক্তিকে শয্যা থেকে সরাতে পুলিশের হস্তক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে।

এসব অভিযোগ স্বীকার করে হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গত রোববার রাতে দায়িত্বরত চিকিৎসককে করোনা ইউনিটের আইসিইউ পরিদর্শন করতে বলি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক পরিদর্শন শেষে আমাকে জানান, তিনটি আইসিইউ শয্যায় থাকা (শয্যা নম্বর ৩, ৪ ও ৫) রোগীর আপাতত আইসিইউ প্রয়োজন নেই। তখন তাঁদের সাধারণ শয্যায় স্থানান্তরের জন্য বলা হলে ওই তিন রোগী শয্যা ছাড়তে রাজি হননি। পরে ওই দিন রাতেই সেখানে পুলিশ পাঠানো হলেও ওই রোগীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁরা তখন শয্যা ছাড়েননি।’

পরদিন সকালে বিষয়টি বিভাগীয় কমিশনার, মহানগর পুলিশ কমিশনার এবং জেলা প্রশাসককে অবহিত করলে বিভাগীয় ও পুলিশ প্রশাসন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনেক অনুরোধের পর সোমবার দুপুরে তাঁরা আইসিইউ শয্যা ছেড়ে দেন।

করোনা ইউনিটের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানান, শুরুতে হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আইসিইউর শয্যা ছিল ২২টি। সোমবার আরও ৪টি বাড়িয়ে ২৬টি শয্যা করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রতিদিন এখানে গড়ে ১০ জন গুরুতর শ্বাসকষ্টের রোগী আইসিইউ শয্যার জন্য অপেক্ষমাণ থাকেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আজ দুপুর পর্যন্ত করোনা ইউনিটে ৩০০ শয্যার বিপরীতে ৩৪৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। আর গত বছরের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত এই ইউনিটে মোট ১ হাজার ১৪৬ জন রোগী মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে করোনা শনাক্ত ৩১৪ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ৮১৪ জন মারা গেছেন।