করোনা পরীক্ষার আওতা বাড়ছে না

করোনাভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় ৯ মাস পরও ৩৫টি জেলায় নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) চালু করতে পারেনি সরকার। সরকারের পরামর্শক কমিটি ছয় মাস আগে করোনা শনাক্তে অ্যান্টিজেন টেস্ট চালুর সুপারিশ করলেও এখনো তা শুরু হয়নি। পরীক্ষাকেন্দ্র নেই এমন ১০টি জেলায় ডিসেম্বর মাসে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর বাকি ২৫টি জেলায় কবে নাগাদ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু হবে, তা এখনো অনিশ্চিত।

দেশে করোনার অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা এখনো চালু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে প্রতিদিন আক্রান্তের যে সংখ্যা দেয়, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। দিনে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখনো দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৮ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়নি। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ১২টি নমুনা পরীক্ষা হওয়ার তথ্য দিয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকে রোগী শনাক্তকরণের ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটির মতে, একজন শনাক্ত রোগীর বিপরীতে ১০ থেকে ৩০টি পরীক্ষা হলে তা পর্যাপ্ত। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত একজন শনাক্ত রোগীর বিপরীতে পরীক্ষার হার ৬ শতাংশের কম। অন্যদিকে সরকার ৯ মাসেও আরটি–পিসিআর পদ্ধতির আওতা বাড়াতে পারেনি। তাই সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা একসঙ্গে শুরু করা জরুরি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

এখন দেশে আরটি–পিসিআর এবং জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফল পেতে সময় বেশি লাগে। আর অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা যায় ১৫ থেকে ৩০ মিনিটে। সহজে, যেকোনো জায়গায়, যে কেউ, কম খরচে এটি করতে পারেন। কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সেটি অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। আর করোনা থেকে যাঁরা সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার সব জেলায় আরটি–পিসিআর পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর পর্যাপ্ত সময় পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি। পরামর্শক কমিটি অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি দুটি পরীক্ষাই চালুর সুপারিশ করার পরে অনেকটা সময় চলে গেছে। যেসব জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র নেই, সেগুলোতে ব্যাপক পরিসরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা দ্রুত চালু করতে হবে।

কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীরগতি

গত ৩ জুন করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনা শনাক্তে এত দিন ধরে চলা আরটি–পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালুর পক্ষে মত দেয়। কমিটির বিশেষজ্ঞরা অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালুরও সুপারিশ করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনার র‍্যাপিড টেস্ট বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে গত ৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালার ওপর মতামত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে। একাধিক সভার পরে কমিটি ২৩ আগস্ট তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব জমা দেয়। কমিটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালুর জোর সুপারিশ করে।

এর আড়াই মাস পরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত ১২ নভেম্বর কোভিড-১৯ পরীক্ষাসংক্রান্ত নীতিমালা করে। নীতিমালা শুরুতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ শনাক্তে নিউক্লিক অ্যাসিড টেস্ট (আরটি–পিসিআর এবং জিন এক্সপার্ট), র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন ও সেরোসার্ভিল্যান্সের জন্য অ্যান্টিবডি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নীতিমালার উদ্দেশ্য শনাক্তকরণ পরীক্ষা স্বল্প সময়ে করা, শনাক্তকরণ পরীক্ষার হার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা।

সরকারের কোভিড-১৯ পরীক্ষা নীতিমালায় বলা হয়েছে, অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে বিশেষায়িত কোনো ল্যাবরেটরির প্রয়োজন হয় না। তবে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সুনির্দিষ্টতা প্রায় শতভাগ হলেও সংবেদনশীলতা কম। ফলে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ ফলাফল পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় নেগেটিভ এলে পিসিআর বা জিন এক্সপার্ট পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। আর অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় পজিটিভ হলে ওই ব্যক্তিকে নিশ্চিত পজিটিভ হিসেবে গণ্য হবে।

নীতিমালা চূড়ান্ত করলেও দেশে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা এখনো চালু হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য কোন কিটটি সবচেয়ে ভালো বা কার্যকর, সেটি নিশ্চিত না হওয়ায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করতে দেরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত দুটি কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, আগামী সপ্তাহে অ্যান্টিজেনভিত্তিক পরীক্ষার জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শেষ হবে। আরটি–পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, এমন ১০টি জেলায় আগামী মাসে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হবে। অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মানসম্মত কিট আনা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে সব জেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করা হবে।

৩৫ জেলাতেই পরীক্ষাকেন্দ্র নেই

এখন দেশে ১১৮টি পরীক্ষাকেন্দ্রে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ১১৬টি কেন্দ্রে আরটি–পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। আর বাকিগুলোয় মূলত যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত কার্টিজ বেজড নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যামপ্লিফিকেশন টেস্ট (সিবি ন্যাট) পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।

পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৬৮টি। আর ঢাকার বাইরে ২৮টি জেলায় আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলার মধ্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে ৮টি জেলায়। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে ৪টিতে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সিলেট বিভাগের ৩টি পরীক্ষাকেন্দ্রই সিলেট জেলায় অবস্থিত। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে বরিশাল ও ভোলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।

গত ১৮ জুন করোনাবিষয়ক নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে আরটি–পিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে। সেদিন দেশের ৪৩ জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল না। এরপর সাড়ে ৫ মাস পার হলেও নতুন করে মাত্র ৮ জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, সব জেলায় আরটি–পিসিআর পরীক্ষা শুরুর মতো পরীক্ষাগার, সক্ষমতা নেই। তবে সব জেলায় আরটিপিসিআর পরীক্ষা চালু করতে সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। যেখানে সম্ভব হচ্ছে সেখানেই পিসিআর পরীক্ষা শুরু করা হচ্ছে।

পরীক্ষাকেন্দ্র নেই এমন তিনটি জেলার সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম না প্রকাশের শর্তে তাঁরা বলেন, জেলায় আরটি–পিসিআর পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা হয়েছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি হয়নি। পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকায় পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে না। জেলার নমুনা পরীক্ষা করতে আশপাশের জেলায় বা ঢাকায় নমুনা পাঠানো হচ্ছে। এতে পরীক্ষার ফলাফল পেতে অনেক বেশি সময় লাগছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৪ থেকে ৫ দিন লাগছে। আবার নমুনা সংগ্রহের পর সেটি দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানোর অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।