করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পথে

আগামী দুই সপ্তাহ রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যাবে।

করোনা ভাইরাস
প্রতীকী ছবি

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমে নিয়ন্ত্রণে আসছে। সংক্রমিত নতুন রোগী, পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার, মৃত্যু—সবই কমছে। দুই দিন ধরে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, আগামী দুই সপ্তাহ পরিস্থিতি এমন থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যাবে।

সংক্রমণ কমতে থাকায় জনজীবনও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারও বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হতে দেখা গেছে। দীর্ঘদিন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখে বিশ্বে উদাহরণ হয়ে উঠেছিল ভিয়েতনাম। কিন্তু এখন যে ১০টি দেশে সংক্রমণ বেশি, তার একটি ভিয়েতনাম। জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ, সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতা ধরে রাখতে যত দ্রুত সম্ভব বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র রোবেদ আমিন গতকাল বুধবার অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে বলেন, বাংলাদেশ এখন ভালো অবস্থানেই আছে।

সংক্রমণ পরিস্থিতি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি ভালো, তবে তার মানে এই নয় যে করোনা চলে গেছে। এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, মাস্ক পরছেন না। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

শুরু থেকে দেশের সংক্রমণ চিত্রে কয়েক দফা ওঠানামা দেখা গেছে। সংক্রমণের গতি ঠেকাতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, যাতায়াত বন্ধ করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারের এ ধরনের ৯টি পদক্ষেপ বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা হয়েছে ‘অক্সফোর্ড কোভিড-১৯ গভর্নমেন্ট রেসপন্স ট্র্যাকার’। সরকারঘোষিত ৯টি পদক্ষেপের জন্য মোট নম্বর ধরা হয়েছে ১০০। এই ট্র্যাকারের তথ্য বলছে, করোনাকালে সরকারঘোষিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের জন্য গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মাস পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৭০-এর ওপরে ছিল। এ ক্ষেত্রে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় তিন দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ব্রাজিল বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে ছিল।

দেশে প্রায় সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো বন্ধ আছে, স্কুল-কলেজও পুরোটা চালু হয়নি। গতকাল পর্যন্ত অক্সফোর্ড কোভিড-১৯ গভর্নমেন্ট রেসপন্স ট্র্যাকারের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নম্বর ছিল ৫২। আর সবচেয়ে ওপরে ছিল ফিলিস্তিন, ৮৭। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও ভেনেজুয়েলা।

অবশ্য সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ ঘোষণা করা হলেও বাস্তবায়নের দিক থেকে শুরুতে দেশে অনেক সময় হযবরল অবস্থা দেখা গেছে। কাগজ–কলমে কঠোর বিধিনিষেধের কথা বলা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ রাখা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন ছিল ঢিলেঢালা। অন্যদিকে রোগী ব্যবস্থাপনা এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ছিল। করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের পর লম্বা সময় পাওয়া গেলেও হাসপাতালের সক্ষমতা বিশেষত জেলা পর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) এবং কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, বিধিনিষেধ কার্যকরের পাশাপাশি যদি রোগী ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতো, তাহলে আরও আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। আগে থেকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে মৃত্যুও কমানো যেত।

শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ জুলাই দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০ হাজার ছাড়ায়। এরপর থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি ছিল। এর মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্তের রেকর্ড হয় ২৮ জুলাই। অন্যদিকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপর ওঠে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর মধ্যে বেশ কিছুদিন শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের বেশি ছিল। আগস্টের প্রথম দিক থেকে রোগী শনাক্তের হার ক্রমেই কমছে।

কোনো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বুঝতে কয়েকটি মানদণ্ড ঠিক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে আছে—টানা তিন সপ্তাহ ধরে মৃত্যু ও নতুন রোগী কমতে থাকা, টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকা। দেশে টানা সাত সপ্তাহ ধরে নতুন রোগীর সংখ্যা কমছে, আর ছয় সপ্তাহ ধরে মৃত্যুও নিম্নমুখী। রোগী শনাক্তও ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২৮ হাজার ৭৩৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৭৬ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরীক্ষার বিপরীতে গতকাল রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ নিয়ে সাড়ে ছয় মাস পর টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দেশে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকল। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। এ নিয়ে ছয় দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু ৫০-এর নিচে। গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ১৭৬ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৬ হাজার ১৩৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৭ হাজার ৩১৩ জনের।

জোর দিতে হবে টিকায়

সংক্রমণ ঠেকানোর বড় অস্ত্র হলো করোনার টিকা। প্রথম দিকেই বাংলাদেশ টিকা এনেছিল। কিন্তু ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিলে গণটিকাদান কর্মসূচিতে হোঁচট খায় বাংলাদেশ। এখন দুই ডোজ টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের তথ্য অনুযায়ী, জনসংখ্যার অনুপাতে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের চেয়ে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে কেবল আফগানিস্তান। শীর্ষস্থানে রয়েছে ভুটান।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে এসেছে, তার মানে এই নয় যে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে গেছে। এর অর্থ সংক্রমণের প্রকোপ কমেছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সময় বিভিন্ন বিধিনিষেধ, বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় ছোট ছোট উদ্যোগের ফলে সংক্রমণ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু খুব আপ্লুত হওয়ার সময় আসেনি। এখনো কিছু জেলায় শনাক্তের হার ১০ শতাংশের মতো। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা তৈরি হচ্ছে, টিকার ক্ষেত্রেও খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায়নি। সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। আর সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে দ্রুত টিকা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। তাহলে সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ এলেও টিকা অনেকটা রক্ষা করবে।