করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের পাশে যেভাবে দাঁড়াতে হবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ হাসপাতালের সব কর্মী করোনাযুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক। এই ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে টানা দুই মাস যুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁরা অনেকেই আজ পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই যুদ্ধে যেমন আছে মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়, তেমনি আছে মৃত্যুর ভয়ও। এই সময়ে দরকার তাঁদের পাশে থাকা। আমাদের একটুখানি সহযোগিতা তাদেঁর মনোবল বহুলাংশে চাঙা করতে পারে।


কোনো যুদ্ধ জয় শুধু সম্মুখসমরের সৈনিকদের ওপর নির্ভর করে না; তার জন্য দরকার দেশের সব মানুষের একীভূত অবস্থান, ব্যাপক সমর্থন এবং সার্বিক সহযোগিতা। যেমনটা হয়েছিল আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে। আমরা বিভিন্নভাবে করোনাযুদ্ধের সাহসী সৈনিকদের পাশে থাকতে পারি। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের পরিবারের সদস্যদের করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক শিষ্টাচার মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তাহলে করোনা মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। ফলে হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীর প্রবাহ কমে যাবে। আর সেটাই হবে করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের জন্য বড়ই স্বস্তির ব্যাপার।


আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বল অবকাঠামোর জন্য দেশের জনসাধারণ দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর অনেকেরই ক্ষোভ রয়েছে; যদিও তাঁরা এর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী নন। বরং দায়ী হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বল অবকাঠামো। তাই সমাজে আজ রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এর একটি করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক রোগীরই আজ চিকিৎসকের ওপর আস্থা নেই। আবার অনেক চিকিৎসকও রোগীকে পুরোপুরি আস্থায় আনতে পারছে না। তাই এখনই সময় করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের পাশে দাঁড়িয়ে অনাস্থার দেয়াল ভেঙে ফেলা।


করোনা সৈনিকদের পাশে থাকতে সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যেমন চিকিৎসাসেবা প্রদানকালে সরকারি হাসপাতালের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে গ্রেড অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং মৃত্যু হলে ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা তাঁর পরিবারকে প্রদান করার বিধান জারি করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে অধিক কার্যকরী করার জন্য এ উদ্যোগটিতে কিছু সংশোধনী আনা প্রয়োজন। লক্ষণ প্রকাশের আগে একজন করোনা রোগী অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। আবার লক্ষণবিহীন করোনা রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তাই সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী সবাই করোনার ঝুঁকিতে রয়েছেন। ফলে তাঁরা সবাই এ প্রণোদনা প্যাকেজের সমান দাবিদার।


কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত যেহেতু মূলত সরকারি হাসপাতালে দেওয়া হচ্ছে, তাই স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য রোগী বা তাঁর পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে খরচ মেটানোর তেমন প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে তাই চিকিৎসা ভাতার পরিবর্তে আক্রান্ত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করে তার সুস্থতার ওপর বেশি জোর দেওয়া দরকার। তা ছাড়া যেহেতু লক্ষণবিহীন করোনা রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাই এ ক্ষেত্রে কারও কারও দুর্নীতিতে জড়িত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অসুস্থকালীন ভাতার পরিবর্তে তাই সব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য করোনা ভাতা দেওয়া যেতে পারে। যেসব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাঁদেরকে মাসে মূল বেতনের দ্বিগুণের সমান এবং যাঁরা সাধারণ রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরকে মাসে মূল বেতনের সমপরিমাণ করোনা ভাতা দেওয়া যেতে পারে। এই ভাতা কার্যকর করা হলে সরকারি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য মাসে মোট খরচ হতে পারে ২০০ কোটি টাকার মতো।


তবে যেসব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী জাতির এই দুঃসময়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না, তাঁদেরকে এই ভাতার আওতায় না আনলে এর পরিমাণ আরও অনেক কমে আসবে। উল্লেখ্য, চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী বর্তমান হারে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হতে থাকলে মে মাসের শেষে এই সংখ্যা পাঁচ হাজারে দাঁড়াতে পারে। তাই গ্রেড অনুযায়ী করোনা চিকিৎসা ভাতা বাবদ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার যে বিধান জারি করা হয়েছে, তার জন্য শুধু মে মাসের মধ্যেই প্রায় ৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে।


স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক চিকিৎসকদের ওপর পরিচালিত একটা ত্বরিত জরিপ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায় যে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সবার জন্য সমান হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এটা জাতির কল্যাণে তাঁদের সাহসী আত্মদানের প্রতিদান। পাশাপাশি চিকিৎসক থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত প্রত্যেকেই হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা ছাড়া এ ক্ষতিপূরণ করোনাযুদ্ধের অন্য সৈনিকদের যেমন সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।


করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের সাহসী আত্মদানের ক্ষতিপূরণ বাবদ সর্বোচ্চ যে ৫০ লাখ টাকা ধার্য করা হয়েছে, তা তাঁর পরিবারের বাসস্থান, সন্তানের লেখাপড়া এবং জীবনধারণের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। অসুস্থ হলে যেখানে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার চিকিৎসা ভাতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে জীবনহানি হলে মাত্র ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্যমতে, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমপক্ষে ২ কোটি টাকা হওয়া উচিত। বাংলাদেশে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯–এ আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৬৭ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৮০০ জনের বেশি। তবে, এ পর্যন্ত ১ জন চিকিৎসক, ১ জন স্বাস্থ্যকর্মী, ৩ জন পুলিশ সদস্য এবং ১ জন গণমাধ্যমকর্মী কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই এই ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারের বাড়তি বরাদ্দের প্রয়োজন না–ও হতে পারে।


করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমেও সরকার তাঁদের পাশে থাকতে পারে। কারও কারও কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণের তুলনায় তাঁদের কাজের স্বীকৃতি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি করোনাসহ সব ধরনের সংক্রামক মহামারি মোকাবিলা করার জন্য যাঁরা অসামান্য অবদান রাখবেন, তাঁদেরকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেতে পারে।


আমরা জানি, যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি যদি সামনে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, তাহলে সৈন্যদের মনোবলের কোনো ঘাটতি থাকে না। আবার যদি প্রধান সেনাপতি বা ফিল্ড মার্শাল যুদ্ধের ময়দানে আচমকা উপস্থিত হন, তাহলে সৈনিকদের মনোবল তুঙ্গে উঠে যায়, যা তাদের যুদ্ধ জয়ে বাড়তি রসদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হলেন করোনাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। আর মন্ত্রীসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা করোনাযুদ্ধের একেকটা যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতি। এই সেনাপতিরা মাঝেমধ্যে সরেজমিনে হাসপাতাল ভিজিট করে করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের সঙ্গে অধিক বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ ও পিঠ চাপড়ে সাহস জোগাতে পারেন।


চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী তাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এবং তাঁদের পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়ে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সেবা করে যাচ্ছেন। তাঁদের এমন মহান আত্মত্যাগকে আমরা যদি যথাসময়ে স্বীকৃতি না দিই এবং পাশে না থাকি, তাহলে হয়তোবা অদূর ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে, যখন সচেতন পরিবারের কোনো সন্তান চিকিৎসা পেশায় আসবেন না। অতএব, জাতির কল্যাণে এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।


তাই আসুন, আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে করোনাযুদ্ধের সৈনিকদের পাশে দাঁড়াই এবং দেশকে চরম বিপর্যয় থেকে বাঁচাই।


ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।
s.a.hamid 73 @gmail. com