করোনার ‘দুষ্টচক্রে’ মনের কষ্ট

করোনাকালে মানসিক অবসাদ। প্রতীকী ছবি।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষ, মারা গেছেন প্রায় আট লাখ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। আর মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজারের কাছাকাছি। এই হাজার, লাখ বা প্রতিদিনের মৃত্যুর তথ্যগুলো আমরা জানছি সংখ্যা হিসেবে। সংখ্যা বাড়লে শঙ্কিত হচ্ছি, আর কমলে নিজেই নিজেকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই সংখ্যাগুলোর আড়ালে স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস কত লম্বা হচ্ছে, আমাদের মনে উদ্বিগ্নতা আর বিষণ্নতার ঝড় কত জোরে বইছে, সেটা অজানাই থেকে যাচ্ছে। সংখ্যা দিয়ে মূলত করোনা পরিস্থিতির চিত্র উঠে আসে। কিন্তু পরিস্থিতির ব্যাপকতা শুধুই কি সংখ্যা দিয়ে বোঝা যায়? মনের দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, আতঙ্ক, দীর্ঘশ্বাস সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। তাই করোনার প্রতিরোধব্যবস্থা, চিকিৎসা, আর টিকা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মহামারিকালে বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টিও আলোচনায় চলে আসছে।

করোনা সন্দেহে তাপমাত্রা পরীক্ষার প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো

করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, আসন্ন অর্থনৈতিক সংকট, কর্মহীনতা, পরিবর্তিত সামাজিক আচরণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং রোগ নিয়ে নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্য ও কুসংস্কারের কারণে বাড়ছে মানসিক চাপ। যাঁরা করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, যাঁরা হননি এবং যাঁরা সম্মুখসারিতে থেকে রোগটি প্রতিরোধে আর চিকিৎসায় কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই কমবেশি মানসিক চাপে রয়েছেন। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বেও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আগের চেয়ে বাড়বে বলে গবেষকেরা ধারণা করছেন। মহামারিকালে বাংলাদেশের মানুষের মনেও চাপ বাড়বে বই কমবে না। বড় মাপের গবেষণা না হলেও প্রকাশিত, অপ্রকাশিত ছোট কয়েকটি গবেষণা আর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সেই ইঙ্গিতই দেয়।

কয়েকটি আত্মহত্যা এবং করোনা

মার্চের শেষ সপ্তাহে জার্মানির হোকহাইম শহরে উদ্ধার করা হয় দেশটির প্রদেশীয় অর্থমন্ত্রী টমাস শাফেরের মৃতদেহ। পত্রিকান্তরে জানা যায়, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে অর্থনৈতিক চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে মন্ত্রী শেফার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।

কেবল পাশ্চাত্যেই নয়, বাংলাদেশেও এমন ঘটনার নজির পাওয়া যাচ্ছে। মার্চের শেষ সপ্তাহে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে ‘অপবাদ’ দেওয়ায় ৩৬ বছরের যুবক আত্মহত্যা করেন। তিনি ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়েছিলেন, সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর কাজের সুযোগ ছিল না। বাড়িতে যেতেই আশপাশের মানুষজন তাঁকে করোনা রোগী সন্দেহে বিদ্রূপ করতে লাগল, তাঁর অপরাধ তিনি ঢাকাফেরত! (কালের কণ্ঠ, ২৫ মার্চ ২০২০)। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় মধ্যবয়সী একজন পুরুষ করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য নগরীর একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে বাসায় আসেন। বাসায় ফিরেই তিনি আত্মহত্যা করেন। (প্রথম আলো ২০ জুন, ২০২০)।

মানুষ যখন তার মানসিক বিপন্নতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, তখনই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া যেন ‘অপরাধ’, যেন এক দারুণ আত্মগ্লানি; এমন ভ্রান্ত অনুভূতি থেকে মনের মধ্যে তৈরি হয় নিদারুণ হতাশা আর অবসাদ। কখনোবা তৈরি হয় তীব্র আতঙ্ক। যার পরিণতি আত্মহত্যা। করোনার পরোক্ষ অভিঘাতেও বিপন্ন হয় মানসিক স্বাস্থ্য। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিরাজগঞ্জে

বাড়ছে বিষণ্নতা, আতঙ্ক আর উদ্বিগ্নতা

মার্চের শেষের দিকে একজন চিকিৎসক ফোন করে আমাকে জানালেন, ঢাকার একটি হাসপাতালে এক তরুণ করোনা নিয়ে ভর্তি। তাঁর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে। আমাকে একটা ফোন নম্বর দেওয়া হলো। আমি যেন সেই নম্বরে কথা বলে তাঁকে চিকিৎসাসেবা দিই। সন্ধ্যায় কয়েকবার চেষ্টার পর তরুণটির সঙ্গে কথা বলতে পারলাম। টেলিফোনে যতটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো তাঁর কনভারশন ডিসঅর্ডারের (আগের দিনে হিস্টিরিয়া বলা হতো) লক্ষণ রয়েছে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললাম।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে একটি সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি থাকা রোগীর জন্য গঠিত সরকারি মেডিকেল বোর্ডের সদস্য হিসেবে সেখানে গিয়ে দেখি, কোভিড জটিলতা কাটিয়ে উঠলেও রোগী মানসিকভাবে যথেষ্ট ভেঙে পড়েছেন। পরে তাঁকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড সংক্রমিত ব্যক্তি, কোভিড সংক্রমিত নন কিন্তু লকডাউনের কারণে বাসায় আছেন, এমন ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস (মানসিক চাপ), উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা, আতঙ্কের (প্যানিক অ্যাটাক) হার সাধারণ সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। চীনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপের হার প্রায় ২৮ শতাংশ আর ভবিষ্যতে তাঁদের পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক সমস্যা) হতে পারে এমন লক্ষণ রয়েছে ৪৩ শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশেও কোভিড-১৯ আর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ছোট আকারের কিছু গবেষণা হয়েছে। জার্নাল অব অ্যাফেকটিভ ডিসঅর্ডার আগস্ট ২০২০-এ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের একটি গবেষণাপত্র।

এ বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া ৫০৫ জন শিক্ষার্থীর ওপর অনলাইনে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, ৪৭ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা এবং প্রায় ২৯ শতাংশের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপজনিত উপসর্গ রয়েছে, যা সাধারণ সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি!

সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এ বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া ৫০৫ জন শিক্ষার্থীর ওপর অনলাইনে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, ৪৭ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা এবং প্রায় ২৯ শতাংশের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপজনিত উপসর্গ রয়েছে, যা সাধারণ সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি! পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় ১ হাজার ৪২৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণকারীর প্রায় ৬০ শতাংশের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপের (স্ট্রেস) উপসর্গ পাওয়া যায়। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আর ওয়েস্টার্ন সিডনি অস্ট্রেলিয়ার আরেকটি যৌথ অনলাইন গবেষণায় দেখা যায়, ১১ হাজার অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৭২ শতাংশেরই এই করোনাকালে নানা ধরনের ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

করোনাকালে মানসিক চাপ আর নানাবিধ মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। ফলে আবেগের পরিবর্তন, ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, ভালো লাগার বিষয়গুলোও ভালো না লাগা, খিটখিটে মেজাজ, রেগে যাওয়া, আগ্রাসী আচরণ করা, ধৈর্য কমে যাওয়া এবং ঘুমের সমস্যা উপসর্গ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।

পারিবারিক সহিংসতা আর বিচ্ছেদ

পেরুতে করোনা সংক্রমণের শুরু হওয়ার পর মধ্য মার্চ থেকে জুনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় ৯১৫ জন নারী নিখোঁজ হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের বেশির ভাগই পারিবারিক সহিংসতার কারণে নিহত হয়েছেন। এই নিখোঁজ হওয়ার হার মহামারি শুরু হওয়ার আগের চেয়ে প্রায় দেড় গুণ। স্পেনে লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে পারিবারিক সহিংসতার হার ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জাতিসংঘের একটি প্রকাশনায় দেখা যায়, লকডাউনের সময় সিঙ্গাপুরে আগের চেয়ে ৩৩ শতাংশ আর ফ্রান্সে ৩০ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে।

চীন, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে লকডাউন শুরু করার পর বেড়ে গেছে বিবাহবিচ্ছেদ। ব্রিটেনে কো-অপ্ট লিগ্যাল সার্ভিসেস নামের একটি আইনি প্রতিষ্ঠান বলছে, ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১৫ মের মধ্যে যে পরিমাণ বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করা হয়েছিল, এ বছর করোনায় লকডাউন চলাকালে এই হার বিগত বছরের চেয়ে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপে দেখা যায়, ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনে ‘ডিভোর্স’ শব্দটি মার্চ মাসের তুলনায় মে মাসে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং ‘ডিভোর্স লইয়ার’ দিয়ে সার্চ করার হার মার্চ মাসের তুলনায় মে মাসে বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অথচ ২০২৯ সালে একই ব্যবধানে এই হার যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ১১ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

বাংলাদেশে ২৭টি জেলায় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, এ বছর কেবল এপ্রিল মাসে ৪ হাজার ২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। নারীরা বেশির ভাগই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বামীর হাতে। যদিও বিগত বছরের সঙ্গে তুলনামূলক কোনো চিত্র ফলাফলে প্রদর্শিত হয়নি। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু জীবনে প্রথমবারের মতো এই করোনাকালেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে।

পারিবারিক সহিংসতার প্রতীকী ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

করোনার ‘দুষ্টচক্র’

মানুষের চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে যখন অনেকখানি ফারাক তৈরি হয়, নিজের পরিকল্পনাগুলো যখন কোনো দুর্যোগে-দুর্বিপাকে এলোমেলো হয়ে যায়, তখন মনের মধ্যে তৈরি হয় হতাশা আর অনিশ্চয়তা। হতাশা থেকে পারিপার্শ্বিকের ওপর তৈরি হয় রাগ। রাগ থেকে আগ্রাসী আচরণ। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাই ‘ফ্রাস্ট্রেশন-এগ্রেশন হাইপোথিসিস’। অর্থাৎ কেউ যখন খুব আগ্রাসী আচরণ করে বা রাগ দেখায়, তখন ধরে নিতে হবে তিনি বঞ্চিত আর হতাশাগ্রস্ত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাগ মানুষের হিতাহিত জ্ঞান লোপ করে, তখন প্রতিটি সিদ্ধান্ত ভুল হয়। ফলে চাহিদা আর প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। এটি একটি ‘দুষ্টচক্র’।

করোনা আমাদের সব হিসাব-নিকাশ এলোমেলো করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনভাবনা থেকে শুরু করে সামষ্টিক পরিকল্পনা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পড়ালেখা, জীবনাচার, পেশা, অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিও পরিবর্তিত হচ্ছে মহামারির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এই পরিবর্তন সর্বতোভাবেই চাপিয়ে দেওয়া পরিবর্তন, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবর্তন। তাই বাড়ছে হতাশা, রাগ আর আগ্রাসন। সেটার প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছে আন্তব্যক্তিক সম্পর্কে। বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা। সঙ্গে সংক্রমণের আতঙ্ক, মৃত্যুভীতি, স্বজন হারানোর শোক এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের মনোজগৎকে বিকল করে দিচ্ছে। বিশ্বজুড়েই মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য আজ বিপন্ন।

উত্তরণের পথ কোথায়

‘কখন আমি মানসিকভাবে সমস্যায় পড়ব’, ‘কখন আমার মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দেবে’, ‘কখন আমার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়বে’—‘সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করব? তারপর এসব দেখা দিলে মনোচিকিৎসকের কাছে যাব।’ এই যদি হয় পরিকল্পনা, তাহলে সমূহ বিপদ।

আরও পড়ুন

ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় এই মুহূর্ত থেকেই মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশে কিছু সচেতনতামূলক প্রচারণা হচ্ছে, কয়েকটি গাইডবই অনাদরে, অবহেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রায় অপঠিত, অব্যবহার্য পড়ে আছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের কিছু প্রশিক্ষণ চলছে। টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে নানা আলোচনা। কিন্তু এগুলো মোটেই যথেষ্ট নয়। ব্রিটেন বা জাপানের মতো উন্নত দেশের উদাহরণ নয়, কাছের দেশ থাইল্যান্ডে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তর রয়েছে, রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা একজন মহাপরিচালক! এই করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে থাইল্যান্ডের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ। যার অন্যতম হচ্ছে ‘ফ্যামিলি ভ্যাকসিন’ নামের একটি কর্মসূচি, যেটাতে মানসিক সমস্যা প্রতিরোধে পরিবারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। ফ্যামিলি ভ্যাকসিন কর্মসূচির তিনটি মূল অনুষঙ্গ হচ্ছে, আশার শক্তি (পাওয়ার অব অপটিমিজম), পরিবর্তনকে গ্রহণ করার শক্তি (পাওয়ার অব ফ্লেক্সিবিলিটি) এবং একে অপরকে সাহায্য করার শক্তি (পাওয়ার অব কো-অপারেশন)। এই কর্মসূচি অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত। আমাদের দেশেও পরিবার আর তৃণমূলের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে লাগিয়ে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এবং তা যেন কেবল কাগুজে কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।

মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান, আজ বা কাল হয়তো করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করবে, কিন্তু মানসিক বিপর্যস্ততার টিকা গবেষণাগারে হবে না। করোনাকালে এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হওয়ার যে আশঙ্কা বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা করছেন, সেটাকে এখনই আমলে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, চোখ, কান, নাক, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ডের মতো আমাদের প্রত্যেকের একটি মন রয়েছে। এই দুর্যোগকালে যদি মনের যত্নের কথা ভুলে যাই, তবে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ডসহ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়বে। ভেঙে পড়বে সামাজিক সাম্যাবস্থা। সেই দুর্যোগ কিন্তু করোনা মহামারির চেয়ে কোনো অংশে খাটো হবে না। দুর্যোগকালীন কর্মপরিকল্পনায়, করোনা মোকাবিলার কর্মকৌশলে মানসিক স্বাস্থ্যকে অবশ্যই যথাযথভাবে সংযুক্ত করতে হবে। বাড়িতে, কর্মস্থলে মনের যত্ন নেব। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া কেবল মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বিষয় নয়, এটি নীতিনির্ধারক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংবাদকর্মী, সমাজ সচেতন প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব।

ডা. আহমেদ হেলাল, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা