করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি নাজুক করে দিতে পারে

সেঁজুতি সাহা বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অণুজীববিজ্ঞানী। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচিত হয়। এখন তিনি অবস্থান করছেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে। সেখান থেকে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, সম্ভাব্য কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। গত রোববার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

সেঁজুতি সাহা

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শীত আসছে। পশ্চিমা বহু দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে, এখানেও দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে। আমরা আসলে কোথায় আছি?

সেঁজুতি সাহা: যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা শুরু করেছি। অনেক জায়গায় আবার কড়া লকডাউন শুরু হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় জাতীয় লকডাউন শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের দেশে এ বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনার তিনজন রোগী শনাক্ত হলো। তারপর থেকে শনাক্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে এক দিনে চার হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে। সেই প্রবণতা এখন কমে গেছে। এ সংখ্যা এখন হয়তো ১,২০০ থেকে ১,৫০০-এর মধ্যে থাকছে। এটা মানতেই হবে যে সংক্রমণের হার কমেছে, আমরা আর শিখরে নেই। তবে পাশাপাশি এ কথাও বলতে হবে, আমাদের প্রথম ঢেউয়ের পর্যায় এখনো শেষ হয়নি। এই মুহূর্তে খুব সাবধানে না থাকলে শীতের সময় বড় একটা ধাক্কা আমরা খেতে পারি।

প্রশ্ন :

কিসের নিরিখে আপনি বলছেন যে করোনার প্রথম ঢেউ আমরা পার হইনি?

সেঁজুতি সাহা: আমি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরে এটা বোঝাতে চাই। যুক্তরাজ্যে এপ্রিল-মে মাসে দৈনিক ৭০০০ থেকে ৮০০০ সংক্রমণ হতো। মারা যেত ১,২০০-র মতো মানুষ। সে সংক্রমণ নেমে এসেছিল ৬০০-তে। আমাদের সংক্রমণ ৪০০০–এ উঠে গিয়েছিল। এখন সংক্রমণ ঘটছে ১,২০০ থেকে ১,৫০০। তার মানে, আমরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সংক্রমণ কমাতে পেরেছি। আমাদের পজিটিভিটির সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের টেস্ট কম হচ্ছে। কিন্তু শনাক্তের হার নমুনা পরীক্ষায় এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। সে কারণে আমরা বলতে পারব না যে সংক্রমণ কমে গেছে। এখন খুব জরুরি হলো, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সংক্রমণের সংখ্যা আরও কমিয়ে ফেলা। তা না হলে দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি অনেক নাজুক করে দিতে পারে।

প্রশ্ন :

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলানোর জন্য প্রথম ঢেউ সামলানো কেন জরুরি?

সেঁজুতি সাহা: এখন আমরা যখন করোনার প্রথম ঢেউয়ে আছি, তখন প্রতিদিন সংক্রমণ হচ্ছেন এক হাজারের ওপরে মানুষ। এ সংখ্যা যদি এক শতে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগ ছড়াবেন এই এক শ জন মানুষ। এক শ জন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এক হাজার মানুষের চেয়ে কম সংক্রমণ ছড়াবেন। তাই এক শ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী নিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে যাওয়া আর এক হাজার জন রোগী নিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক বড়। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা অনেক বেশি। চীনের মতো দেশেও মাঝেমধ্যে হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তারা পুরো একটি শহরের কয়েক লাখ মানুষকে একযোগে টেস্ট করাতে পারছে। আমাদের তো সেই ব্যবস্থা নেই। তাই আমাদের প্রথম ঢেউ প্রশমন খুব জরুরি।

প্রশ্ন :

শীতে আশঙ্কা বেশি হওয়ার কারণগুলো কী?

সেঁজুতি সাহা: শীতে শ্বাসতন্ত্রের রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। সে সময় এমনিতেই বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক লোকদের নিউমোনিয়া, ঠান্ডা, জ্বর-কাশি বেশি হয়। নিউমোনিয়ার মতো রোগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে। এসব রোগ হলে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে জটিলতা বেড়ে যায়। শীতে মানুষ ঘরেও বেশি থাকে। আর বদ্ধ জায়গায় ভাইরাস ছড়ায়ও বেশি। এই পরিস্থিতিতে করোনা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। আরেকটি শঙ্কার কারণও দেখতে পাচ্ছি। এখন ঠান্ডা-কাশি-জ্বর হলেই অনেকে সন্দেহ করছেন তিনি কোভিডে আক্রান্ত। এসব ঘটনায় অনেককে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। রোগীর করোনার টেস্ট রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কারণেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। শীত মৌসুমে যেন করোনার কারণে স্বাভাবিক চিকিৎসা অবহেলিত না হয়, এ নিয়ে খুব সতর্ক থাকা দরকার। এর জন্য টেস্টিংয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শিশু বা বয়স্ক লোকদের যে চিকিৎসা আমরা গত বছর বা তার আগের বছর দিয়েছি, এবার যেন সেটাও দিতে পারি। আর করোনা শনাক্তের নিরিখে দেখতে পাচ্ছি, গত বেশ কিছুদিন আমরা একই জায়গায় থমকে আছি। স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। মানুষজনের মধ্যে বেশ শিথিল মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তাই সচেতনতা বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে আপনি প্রথম করোনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছিলেন। এরপর আরও কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। সেসব উপাত্ত থেকে করোনার গতিপ্রকৃতি বাংলাদেশে কেমন বুঝতে পারছেন?

সেঁজুতি সাহা: আমরা ভাইরাসের গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখছি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ৩২৫টির ওপরে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে। আমাদের দেশে কোন কোন ভাইরাস ছড়াচ্ছে, তা আমরা দেখছি। করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতি যে খুব বেশি বদলে গেছে, তা বলা যাবে না। একটা ভালো খবর হলো, প্রথম দিকে বেশ কিছু দেশ থেকে করোনাভাইরাস আমাদের দেশে ঢুকেছে। এটা আমরা জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকেই বলতে পারছি। তারপর লকডাউন শুরু হয়ে গেলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, দেশে নতুন কোনো ভাইরাস ঢুকতে পারেনি। এটা খুবই ভালো একটা খবর। তবে আকাশপথে আবার যোগাযোগ শুরু হচ্ছে। দেশের বাইরে মানুষের চলাচল শুরু হয়েছে। আমাদের সচেতন থাকা জরুরি।

প্রশ্ন :

করোনায় অল্পবয়সী বা শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আলোচনায় ঊহ্য থেকে যাচ্ছে। আপনারা শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?

সেঁজুতি সাহা: করোনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সত্যিই খুবই কম আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে একটা গবেষণায় আমরা দেখেছি, ২৮ দিন বা তারও কম বয়সী নবজাতকের মধ্যেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ২৬টি নবজাতককে আমরা ঢাকা শিশু হাসপাতালে শনাক্ত করেছি। তাদের মধ্যে ৮টি শিশু মারা গেছে। হাসপাতালে ওদের অসুখের বৃত্তান্তে দেখা যায়, ২টি শিশুর করোনাভাইরাসজনিত জটিলতা ছিল। বাকি ৬টি শিশুর করোনাভাইরাসের পাশাপাশি অন্য ধরনের জটিলতাও ছিল। বেশির ভাগ শিশুই হাসপাতালে এসেছিল অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে। টেস্ট করে দেখা যায়, ওদের করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছে। কোনো শিশুর করোনা হয়ে গেলে তাকে অন্য রোগের জন্য চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য কিছু শিশু করোনাভাইরাসের কারণে নয়, বরং অন্য রোগের চিকিৎসা না পাওয়ার জন্য মারা গেছে বা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থেকেছে। শিশুর প্রসব খুব নিরাপদে হওয়া দরকার। অনেক গবেষণাতেই দেখা গেছে, প্রসব নিরাপদ হলে মা আক্রান্ত থাকলেও শিশুর মধ্যে করোনা ছড়ায় না। হাসপাতালে বা অন্য প্রসব ক্ষেত্রে জীবাণুমুক্ত নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা খুবই জরুরি।

প্রশ্ন :

করোনায় আক্রান্ত লোকজনের কেউ কেউ দ্বিতীয়বার আবার আক্রান্ত হয়েছেন। আপনাদের গবেষণা এ ব্যাপারে কিছু বলছে?

সেঁজুতি সাহা: বিশ্বের বেশ কিছু জায়গা থেকে করোনায় দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি আমরা। বাংলাদেশেও পত্রপত্রিকায় দেখেছি। কেউ কি আসলেই দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেন, নাকি এটি দীর্ঘায়িত অসুস্থতা—সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে দেখতে হলে গবেষণাগারে অনেক রকমের পরীক্ষার পরই বলা যাবে। তার আগে নয়। আমাদের গবেষণাগারে এ ধরনের বেশ কিছু গবেষণা চলছে। আশা করি শিগগিরই আপনাদের কিছু জানাতে পারব।

প্রশ্ন :

স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা আমাদের মতো জনবহুল এবং নিম্নবিত্ত মানুষের আধিক্যের দেশে বেশ কষ্টসাধ্য। এ ক্ষেত্রে মাস্ক পরা ও হাত ধোয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

সেঁজুতি সাহা: আমাদের দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সত্যিই খুব কঠিন। কিন্তু মাস্ক পরা বা হাত ধোয়ার মতো কাজগুলো করা অনেক জরুরি। বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ, বাতাসে আর্দ্রতা খুব বেশি। এ কারণেও অনেকেই মাস্ক পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কিন্তু মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা উচিত। সরকার এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। সরকার তার কাজ করবে, কিন্তু দায়িত্ব তো আমাদেরও থাকবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কর্মীরা তো মাস্ক পরবেনই। ভোক্তা যাঁরা তাদের কাছে আসবেন, মাস্ক পরা ছাড়া তারা সেবা পাবেন না। সমাজে যেসব ব্যক্তির প্রভাব আছে, গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা প্রচারকাজে অংশ নিতে পারেন। অনেকে নিচ্ছেন, কিন্তু এটা বজায় রাখা দরকার। সেলিব্রিটিরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। শুধু নিজে মাস্ক পরাটাই যথেষ্ট নয়, অন্যদেরও মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ১০ জন মানুষের মধ্যে ৯ জন মানুষ যদি মাস্ক না পরেন, তাহলে একজনের জন্য পরাটা কঠিন। এ ব্যাপারে দায়িত্ব আমাদের সবার।