করোনার সংক্রমণ তিন কারণে ঊর্ধ্বমুখী

করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও ভিড়ের মধ্যে মুখে মাস্ক ব্যবহার করছেন না অনেকে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায়।
ছবি: জাহিদুল করিম

মূলত তিনটি কারণে দেশে আবার করোনার সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যে পরিবর্তিত ধরন বা ইউকে ভেরিয়েন্ট দেশে দ্রুত ছড়াচ্ছে। এ সময়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে উষ্ণ আবহাওয়া। স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করে অবাধ চলাফেরাও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ভূমিকা রাখছে।

অবশ্য জেনেভার বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলেছে, আবহাওয়ার সঙ্গে করোনাভাইরাসের ব্যাপকতার সম্পর্কটি এখনো স্পষ্ট নয়। ভবিষ্যতে মৌসুমি রোগ হিসেবে কোভিড-১৯ থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ৪২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের এ বিশেষায়িত সংস্থা। দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।

সংক্রমণ বৃদ্ধির তিন কারণ ১. যুক্তরাজ্যের করোনার পরিবর্তিত ধরন বা ইউকে ভেরিয়েন্ট ২. উষ্ণ আবহাওয়া ৩. স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করে অবাধ চলাফেরা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল শুক্রবার দেশে ১ হাজার ৮৯৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত
ের তথ্য জানিয়েছে। নমুনা পরীক্ষার তুলনায় নতুন রোগী শনাক্তের হার ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আগের দিনও শনাক্তের হার ১০ শতাংশের বেশি ছিল। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আক্রান্ত ও আক্রান্তের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক বছর পর সংক্রমণ পরিস্থিতির নতুন মাত্রায় মানুষের মধ্যে বেশ উদ্বেগ লক্ষ করা যাচ্ছে।

দুই মাস আগে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেছিলেন, ২০২০ সালে ১০০ মানুষ সংক্রমিত হওয়ার আগেই সরকার লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছিল। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে, পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। জীবিকার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার হয়তো লকডাউনে যাবে না, তবে কিছু কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’

এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কী করছে, তা নিয়ে অনেকটাই অন্ধকারে রয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ। নিজেদের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতবিনিময় বা সভা প্রায় বন্ধ হওয়ার পর্যায়ে। কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সর্বশেষ ১০ জানুয়ারি অধিদপ্তরের সঙ্গে সভা হয়েছিল। জানি না কমিটি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, অধিদপ্তর তা নিচ্ছে না।

‘ইউকে ভেরিয়েন্ট’

করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্যে পরিবর্তিত ধরন বা ইউকে ভেরিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাইরাস এখন একটু বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে অন্য ভেরিয়েন্ট ছিল, এখন ইউকে ভেরিয়েন্ট ছড়াচ্ছে। যত ছড়াবে, ভাইরাসের রূপান্তরের আশঙ্কা তত বেশি। রূপান্তরিত হয়ে “বাংলাদেশ ভেরিয়েন্ট” হওয়ার ঝুঁকিও আছে।’

বিসিএসআইআর সূত্র বলছে, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) সর্বশেষ ১২০টি করোনারভাইরাসের জিন বিশ্লেষণের কাজ শেষ করেছে গত বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল ইউকে ভেরিয়েন্ট।

গত বছরের শুরুর দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর এ ভাইরাসের ২০ হাজারের বেশি রূপান্তর ঘটেছে বা মিউটেশন হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে রূপান্তরিত নতুন ধরন শনাক্ত হয়। নতুন এ ধরনের সংক্রমণ করার বা মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, প্রায় ৭০ গুণ।

গত সপ্তাহে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারি দেশে প্রথম ইউকে ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয় যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের নমুনা পরীক্ষায়।

গতকাল বিকেলে তাহমিনা শিরিন জানান, আইইডিসিআরের পরীক্ষাগারে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬ জনের নমুনায় ইউকে ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। আইইডিসিআর করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে নতুন ধরন সম্পর্কে জেনেছে।

দেশে এখন ২১৯টি কেন্দ্রে করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা পরীক্ষা হয়। তবে সব কেন্দ্রে জিন বিশ্লেষণ হয় না, হয় গুটি কয়েক কেন্দ্রে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোগতত্ত্ববিদ প্রথম আলোকে বলেন, এক মাস আগে একাধিক পরীক্ষাকেন্দ্রের নমুনায় ইউকে ভেরিয়েন্ট পাওয়া গিয়েছিল। কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংসহ (আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খোঁজা) অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

পেছনে আবহাওয়া

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল মূলত গত বছর মার্চ থেকে আগস্ট মাসে। এই ছয় মাসের আবহাওয়া মূলত উষ্ণ থাকে। শীতের আবহাওয়ায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। শীত শেষে উষ্ণ আবহাওয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ আবার বাড়ছে।

বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতির বিষয়ে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শীতের আবহাওয়া এ দেশে জ্বর, সর্দি, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের প্রকোপ থাকে। এদের উপস্থিতির কারণে নোবেল করোনাভাইরাসের প্রাবল্য কম ছিল। উষ্ণ আবহাওয়ায় অন্য ভাইরাস অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে, এককভাবে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি এখন বেশি। তাই সংক্রমণ বাড়ছে।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা সংক্রমণ কমবেশি হওয়ার পেছনে আবহাওয়ার চেয়ে দেশগুলোর সরকার গৃহীত পদক্ষেপ বেশি ভূমিকা রেখেছে। করোনা সংক্রমণে আবহাওয়া ও বায়ুদূষণের প্রভাব নির্ণয় করার জন্য ১৬ জন বিশেষজ্ঞ এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের পক্ষে এমন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাসজনিত সংক্রমণ সাধারণত মৌসুমভিত্তিক। হেমন্ত-শীতে ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় করোনার সংক্রমণ বেশি। করোনাভাইরাস যদি আরও কয়েক বছর থেকে যায়, তাহলে তা মৌসুমি প্রবল রোগ হিসেবে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টিকাদান ছাড়া বাংলাদেশে বর্তমানে দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড মাঠপর্যায়ে নেই। একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সবকিছু চলছে মহামারি শুরু হওয়ার আগের অবস্থায়। গত বছর মার্চ মাস থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। পর্যটনকেন্দ্রে মানুষের ভিড়ের কমতি নেই। বিয়ে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে সমাগম থেমে নেই। এসব ক্ষেত্রে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘এসব কারণে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী।’

গত বছর এই সময় সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল। তারপরও ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার।

১৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে নির্দেশনা পাঠিয়েছিল। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও সব সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে একই ধরনের নির্দেশনা পাঠানো হয়। তাতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানোর কথাও বলা হয়। তবে মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে না। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, কঠোর পদক্ষেপ না নিলে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।