গেল বছর করোনা পরবর্তী জটিলতা এমআইএস-সিতে আক্রান্ত ২৪৩ শিশু, মৃত্যু ১১ জনের

শিশু

রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে গত বছরের জুনে গাজীপুরের একটি শিশুকে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তীব্র জ্বরে ভুগছিল শিশুটি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার দুই দিন পর শিশুটির জ্বর আসে। আবার শিশুটিকে হাসপাতালে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায়, সে করোনায় আক্রান্ত। করোনাপরবর্তী শারীরিক জটিলতা মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমটরি সিনড্রোম ইন চিলড্রেনে (এমআইএস-সি) ভুগছে সে। দেড় মাস পর শিশুটি বাড়ি ফেরে।

তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি শিশুটি। গত ডিসেম্বরে তার আবারও তীব্র জ্বর আসে। সঙ্গে ছিল কাশি ও শ্বাসকষ্ট। হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালি ফুলে গিয়েছিল। তখন শিশুটিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার দ্বিতীয়বার এমআইএস-সি শনাক্ত হয়। শিশুটি এখন সুস্থ, তবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

লক্ষণগুলো কী

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২১ বছরের কম বয়সী মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। করোনায় আক্রান্ত হলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এ জটিলতা দেখা দেয়। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ফাহমিদা জাবীন জানান, আক্রান্ত শিশুর তীব্র জ্বর হয়। অন্য লক্ষণগুলো হলো দুর্বলতা ও অবসাদ, শরীরে লাল ফুসকুড়ি, পেটব্যথা, বমি, ডায়রিয়া, ঠোঁট লাল হওয়া ও ফেটে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে ওঠা এবং হাত-পা ফুলে যাওয়া। এ ছাড়া শিশুর রক্তনালিতে প্রদাহ দেখা দেয়। এ প্রদাহ রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা হৃদ্‌যন্ত্র, কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতির কারণ হয়।

বছরে শনাক্ত ২৪৩ শিশু

দেশে শিশুদের মধ্যে করোনাপরবর্তী জটিলতা এমআইএস-সির সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য, ২০২১ সালে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে নয়টি হাসপাতালে ২৪৩ শিশুর এমআইএস-সি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১১ শিশু।

নয়টি হাসপাতাল হলো বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল।

এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ডা. এম আর খান শিশু হাসপাতাল এমআইএস-সিতে আক্রান্ত শিশুর তথ্য দিয়েছে। ওই বছর আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ১৫। মৃত শিশুর সংখ্যা ১। তবে সব হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণ করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার মধ্যেও শিশুদের এমআইএস-সি শনাক্তের বিষয়টি আলাদা করে নজরে রাখা হচ্ছে। তবে দেশের সব হাসপাতালের কাছ থেকে তথ্য পায় না আইইডিসিআর। অবশ্য এমআইএস-সি নিয়ে ভীতি কমেছে। দ্রুত শনাক্ত হওয়ায় আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হচ্ছে।’

দেশে প্রথম শনাক্ত ও মৃত্যু

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাজ্যে এমআইএস-সি প্রথম শনাক্ত হয়। আর গত বছরের ১৫ মে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে দেশের প্রথম এমআইএস-সি রোগী শনাক্ত হয়। ১ অক্টোবর স্কয়ার হাসপাতালে এক কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, দেশে এমআইএস-সিতে আক্রান্ত হয়ে এটাই প্রথম মৃত্যুর ঘটনা।

এভারকেয়ার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে হাসপাতালটিতে এমআইএস-সিতে আক্রান্ত হয়ে ৪০ শিশু ভর্তি হয়েছিল। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২০। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাসপাতালটিতে এমআইএস-সিতে আক্রান্ত হয়ে একজন ভর্তি হয়। এ সময় কেউ মারা যায়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগে ২০২০ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এমআইএস-সিতে আক্রান্ত ১২ শিশু চিকিৎসা নেয়। মারা যায় ২ জন। ১৭ দিন থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ২ জনের করোনা পজিটিভ ছিল। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এখানে ২২ শিশু এমআইএস-সির চিকিৎসা নেয়। মারা যায় একজন। ওই শিশুটির এমআইএস-সির সঙ্গে ডেঙ্গু এবং কিডনি ও হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা ছিল। গত নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ হাসপাতালে চার শিশুর এমআইএস-সি শনাক্ত হয়। চারজনই করোনায় আক্রান্ত ছিল। সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক শিরীন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত করোনায় আক্রান্ত হলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার আট সপ্তাহের মধ্যে শিশুর এমআইএস-সি হয়। অ্যান্টিবডি টেস্ট ছাড়াও রক্তের সিআরপির উচ্চমাত্রাসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত হলে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যদিকে, সুস্থ হলেও আক্রান্ত রোগীর দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিতে হয়।