কুহকের টানেই জীবনে ফেরে মানুষ

হাসপাতালে প্রবেশের আগমুহূর্তে দেখি, ধুলো মাটির পৃথিবীতে তরঙ্গ উঠেছে সেদিন। রিকশাচালকের সঙ্গে ভাঙতি নিয়ে ঝগড়া করছেন সওয়ারি, ম্যাচের কাঠি সাপের মতো ফুঁসে উঠে নিভে গেল কারও সিগারেটের মুখে, ফুটপাতে দুই শিশু বিক্রেতার শ্রবণ অযোগ্য বাহাস, করোনা বিজয়ীর জন্য হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষারত স্বজন। এসব সামান্য দৃশ্য অর্থময় হয়ে ওঠে না সব সময়। শীতের বেলার স্বল্পায়ুর সূর্য ডুবে মহাখালীর ভিড়ে মিশে যাওয়ার আগমুহূর্তে প্রবেশ করলাম রেড জোনে। জানলাম আয়ুর সুতায় টান পড়লে চেনা পৃথিবীর রূপ বদলায়।

অভ্যন্তরে প্রবেশের মানেই জগৎ–বিচ্ছিন্নতা। ঘটনাক্রমে যেতে হলো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে। কয়েক দিন লড়াইয়ের পর সেদিন সকালে এক নম্বর বেডের করোনা রোগী পরাজিত হয়েছেন। দুপুরে তাঁর মরদেহ নিয়ে গেলে সেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এই দ্বিতীয়, তৃতীয় নিয়ে নানা মত। এমন কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়নি যে নিশ্চিত বলা চলে। তবে পরিস্থিতির গতি থেকে টার্মটিকে সমর্থন করছি। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতির সম্পর্ক আছে। মহাখালীর ইউনিভার্সেল নামে বেসরকারি হাসপাতালটিতে করোনা ডেডিকেটেড কেবিন ও ওয়ার্ড দুটোই বন্ধ ছিল কিছুদিন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও করোনা রোগীর সংখ্যা কমেছিল, যা নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আবার বাড়ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক কোমরবিডিটির অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠালেন।

টেলিভিশনে দেখা চায়ের বিজ্ঞাপনে সেই পুরো নাম বলতে পারলেই ক্লাস থ্রিতে ওঠা ময়না পাখির মতো আমারও প্রমোশন হলো। কোভিড-১৯ অতিমারির শুরু থেকে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বা ওয়েবিনারের মতো শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচয় হলেও এবার অভিধানে যুক্ত হলো লিম্ফোসাইড কাউন্ট, ফেরিটিন, ডি ডাইমার বা টিআরপি। সবই করোনার মাপকাঠি। হাসপাতালে না এলে এত দ্রুত ভেতরে কী ঘটছে জানা হতো না। ৯৫ শতাংশ মানুষ এখনো বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এ সংখ্যা প্রাণহানির শঙ্কা বাড়ায়।

আইসিইউতে আমি ১ নম্বর বেডে আর নিকটতম প্রতিবেশী সুদর্শন তরুণ। ২ নম্বর বেডে হাই ফ্লো অক্সিজেন সাপোর্টে থাকা সেই তরুণের চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। গত তিন সপ্তাহে ৮ বার তাঁর করোনা নেগেটিভ-পজিটিভ হয়ে চিকিৎসকদের বিভ্রান্ত করেছে। ৪ নম্বর বেডের বর্ষীয়ানের হাত–পা বাঁধা। শরীরের সবই বিকলের পথে বলে অস্থিরতা বেশি। সিট থেকে উঠে যেতে চান। ৫ নম্বর বেডের রোগীর বুকের ভেতর থেকে যন্ত্র চলার মতো শব্দ আসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার। বাতাস থেকে টেনে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে না পারার দৃশ্য আতঙ্কের। হিমমাখা ঘরে মানুষের চেয়ে বেশি যন্ত্রপাতির আয়োজন। রোগীদের পোশাক নীল। পিপিই গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চিকিৎসক, সিস্টাররা। এত কিছু ঘটে চলেছে এ ঘরে অথচ শব্দহীন। প্রতিবেশীর দিকে তাকাই। তরুণের ডান হাতে আর ক্যানোলা করার অবস্থা নেই। সিটের ওপর অবশ হয়ে রয়েছে কালচে নীল হয়ে যাওয়া শত ছিদ্রের সে হাত। পরিচয়পত্রে লেখা নাম সাইদুর রহমান, বয়স ৩৫।

রাতে আমার জন্য ওয়ার্ড খোলা হলো। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ হাসপাতালের ওয়ার্ডে আমি প্রথম এবং তিন দিন পর্যন্ত একমাত্র রোগী। বড় ঘরটির বাকি তিনটি বিছানার সাদা চাদরে জানালা দিয়ে আসা আলোয় বিচিত্র নকশা হয়। জানালার ওপাশে পরিত্যক্ত জায়গা। সেখানে সদ্য মা হওয়া বিড়াল শিশুশাবক নিয়ে জায়গা বদলায়। অনেক দূরে থাকা আমার মায়ের মুখ মনে করি। তিনি এখন জায়নামাজ থেকে ওঠেন না। বিশাল এক কক্ষ পেয়ে রুমের এমাথা-ওমাথা হাঁটাহাঁটি করি। সন্ধ্যায় চিকিৎসক এসে বলেন, আপনার রক্তের ঘনত্ব বাড়ছে। একদিন সন্ধ্যায় পুরো ঘর ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলে ভাবি আগুন লেগেছে। সিস্টার বললেন, মশার ওষুধ স্প্রে হয়েছে। বুঝতে পারি ঘ্রাণশক্তির সামান্যও কাজ করছে না। অথচ পৃথিবী এক আশ্চর্য ঘ্রাণময় বাসস্থান! সেই ঘ্রাণ নিতে চেষ্টা করি। রোজ সন্ধ্যায় রহিমা নামে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ডিউটিতে আসেন। দায়িত্ব শুরুর আগেই ভালোবেসে আমার চুল বেঁধে দেন। দোলাচলে থাকতে থাকতে আবার দেখা হয় আইসিইউর সাইদুরের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করি, কেমন শরীর? দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে জানান, ভালো আছেন। এত দ্রুত আমার শরীরের উন্নতি দেখে তাঁর চোখের অসহায় ভাব আরও তীব্র হয়। হাসি দিয়ে আশ্বস্ত করি, আপনিও দ্রুত সুস্থ হয়ে এ ঘর থেকে বের হবেন। সাইদুর বালিশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকেন।

আইসিইউ থেকে রুমে প্রমোশন পাওয়ায় সীমিতভাবে সেলফোন ব্যবহারের অনুমতি মেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান দিই অসুখের। ইনবক্সে উপহার আসে হাজার সারসের একটি। এক সুহৃদ ইউটিউব দেখে সারস বানিয়ে প্রার্থনা করছে ফিরে আসার। জাপানে রোগীর সুস্থতা কামনায় ৯৯৯টি সারস বানিয়ে অপেক্ষা করা হয়, অসুস্থ মানুষটি ফিরে বাকি একটি বানিয়ে হাজার পূর্ণ করবে। প্রতিদিন দুপুরে মনে করে খবর নেন আমাদের সম্পাদক মতিউর রহমান। মানসুরা আপার সঙ্গে ভুল মিষ্টি নিয়ে হাসাহাসি করি কিন্তু তারপর? একসময় সবাই তাঁদের জগতে ফিরে যান। ‘শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে’ মৃত্যুমুখের মানুষের কাছে।

করোনার জন্য আপাত–অস্পৃশ্য আমি সাদা বিছানার চাদরের ভেতর নিজেকে ফেলে রাখতে রাখতে হিসাব করি, কতটা জরুরি ফিরে আসা। সারা রাত নির্ঘুম। সিস্টার এসে বিনা ভয়ে স্পর্শ করেন। হিমোগ্লোবিন মাপার গ্লুকোমিটার দেখে বলি, ফেস পাউডার? আমার সৌন্দর্যচর্চার উপকরণের জ্ঞানের বহর দেখে হাসাহাসি করে ওরা। কোথাকার কোন অপরিচিত কতগুলো মানুষ, তারাই এখন একমাত্র মানবস্পর্শের অনুভব বাঁচিয়ে রেখেছে আমার জন্য। এ সবই জীবনের নিভৃত কুহক।

চতুর্থ দিন মাঝরাতে একজন বলল, দেখতে চান একবার? পাশ ফিরে শুয়ে বলি, কখন যাবে? হয়তো ভোরে। ভোররাতে জানালায় দাঁড়াই। ৩৫–এর সাইদুরের মরদেহ বের হয় হাসপাতাল থেকে। সাইদুর হাসপাতালে ভর্তির সময় তাঁর পাঁচ বছরের সন্তানকে বলেছিলেন, দ্রুতই আসব অপেক্ষা করো। পিতার জন্য অপেক্ষা এখন আজীবনের হয়ে যায় সে সন্তানের জন্য। জানালা থেকে সরে আসি। দুপুরে খবর পেলাম, আমার সহকর্মী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানকে নিয়ে আসা হয়েছে একই হাসপাতালে। তাঁর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে, অবস্থা কিছুটা জটিল। মিজান ভাই তাঁর মেয়েকে গাড়ি চালানো শেখাতে নিয়ে যেতেন ৩০০ ফুটের রাস্তায়। সে মেয়েটি এখন বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছে। বহুদূরে বসে থাকা আমার পিতাকে এ কয় দিনে প্রথম ফোন করি। জীবন সংশয় নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না। কান্না জড়ানো কণ্ঠে শুধু বলেন, ‘আমার মঞ্জু।’ কে যেন তখন আয়ুর সুতা আলগা করে ছেড়ে দেয়। টের পাই এখনো জীবনে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ ভোর প্রতিদিন আসার আশাটুকু আছে। ওই এক আহ্বানে বিশ্বাস দৃঢ় হয়, জীবনে ফেরার। এখন কুয়াশায় সকাল হয়। সুস্থ হলে ফরিদপুর যাব। খুব ভোরে আমরা কুয়াশা কেটে কেটে সামনে এগিয়ে যাব, ছোটবেলার মতো তখন আমি তাঁর হাত ধরে আছি। তিনি আবার গাঢ় স্বরে ডাকবেন... সন্তানের নাম। কে যেন বলে, জীবনের এই সব নিভৃত কুহকের টানে শুধু বেঁচে থাকাটাই জিতে যাওয়া।

(লেখক: নির্বাহী প্রযোজক, নিউজ, প্রথম আলো মাল্টিমিডিয়া)