কেউ মারা গেলেই কেবল অন্য রোগী পাচ্ছে আইসিইউ

শয্যা ফাঁকা না পেয়ে জরুরি বিভাগ থেকে ১৪ রোগীকে নিয়ে ফিরে যান স্বজনেরা।

শ্বাসকষ্ট প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় আজিজুল হককে স্বজনেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আইসিইউ শয্যা না পেয়ে আলাদা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে সাধারণ শয্যায় ভর্তি করানো হয় তাঁকে। গতকাল দুপুরে হাসপাতালের সামনে
ফাইল ছবি।

জরুরি বিভাগের সামনে অক্সিজেন মাস্ক মুখে নিয়ে বসে আছেন ৫৮ বছর বয়সী খন্দকার আবদুল হাই। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট তাঁর। অক্সিজেন মিটারের লেভেল কমে ৭৩-এ ঠেকেছে। চিকিৎসক দেখে পরামর্শ দিলেন, সার্বক্ষণিক অক্সিজেন ও আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে তাঁর। স্বজনেরা হয়রান হন একটি শয্যার জন্য। কিন্তু মুগদা হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। আরও দুটি হাসপাতালে খোঁজ করেও শয্যা মিলল না।

তবে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর আবদুল হাই ভর্তি হতে পারেন। চিকিৎসকেরা জানান, ঘণ্টাখানেক আগে করোনা আইসিইউতে ভর্তি থাকা এক রোগী মারা যান। সে আসন ফাঁকা হওয়ায় তাঁকে ভর্তির সুযোগ এল। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মারুফ হোসেন সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, দেড় মাসের বেশি সময় ধরে এ হাসপাতালে আইসিইউ সার্বক্ষণিক রোগীতে পরিপূর্ণ থাকছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে, এমন রোগী বেশি আসছে। তিনি বলেন, সবাইকে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। কেউ মারা গেলে আরেকজন সংকটাপন্ন রোগীকে ভর্তির ব্যবস্থা হচ্ছে। পরিস্থিতি অনেক খারাপ।

একটি আইসিইউ শয্যার জন্য অপেক্ষা ঢাকার বেশির ভাগ হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে তিনটি হাসপাতালে আইসিইউ নেই। বাকি ১৪টি হাসপাতালের মধ্যে ১২টিতেই গতকাল কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। ৫টি হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ আসন ফাঁকা ছিল। আর সারা দেশে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৮৯১টি। এর মধ্যে ৮১৩টিতে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সাদারঙা বড় একটি বোর্ডে গতকালের তারিখ উল্লেখ করে লেখা, কোভিড-১৯ বিছানা খালি নেই। আরও লেখা, পুরুষ-নারীর বিছানা খালি নেই। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) কোনো বিছানাই খালি নেই। সবশেষে নিচে আরও বড় অক্ষরে লেখা, ‘দুঃখিত, বিছানা খালি নেই’।

এখন যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকে অক্সিজেন পাবেন না। এ কারণে বাধ্য হয়ে এ মুহূর্তে নতুন রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।
অসীম কুমার নাথ, পরিচালক, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পরপর রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসছে। চার ঘণ্টায় হাসপাতালে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে রোগী আসেন ১৮ জন। শয্যা ফাঁকা না পেয়ে জরুরি বিভাগ থেকে ১৪ জন রোগীকে নিয়ে ফিরে যান স্বজনেরা। তাঁদের প্রত্যেকেরই মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। বাকি চারজনকে সেখানে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়।

দুই হাসপাতাল ঘুরে দুপুরে মুগদা হাসপাতালে আনা হয়েছে ৬৭ বছর বয়সী মমতাজ বেগমকে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। তবু তীব্র শ্বাসকষ্টে কোঁকাচ্ছেন তিনি। তাঁর ভাগনে মো. শাহ আলম জানান, শুক্রবার রাতে রাজধানীর খিদমাহ হাসপাতালে মমতাজকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আইসিইউ ফাঁকা নেই বলে ভর্তি করানো যায়নি। এরপর গতকাল সকালে মালিবাগের প্রশান্তি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও আইসিইউ ফাঁকা নেই। শেষমেশ মুগদা হাসপাতালে আনা হলে মমতাজের শারীরিক অবস্থা দেখে চিকিৎসকেরা বলেন, এক্ষুনি মমতাজ বেগমের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। অবশেষে দুই ঘণ্টা হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষার পর মমতাজ বেগমকে এইচডিইউতে ভর্তি করানো হয়।

ফিরে যাওয়া রোগীদের একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার মো. ফিরোজ আলম (৫৬)। শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেওয়ায় প্রথমে তাঁকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় তিনি করোনায় আক্রান্ত বলে জানা যায়। শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকেরা তাঁকে আইসিইউ সুবিধা আছে, এমন হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেন। পরে আনা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা সদর হাসপাতালে। তাঁর ছেলে এনামুল হক বলেন, আইসিইউ ফাঁকা নেই, তাই তাঁর বাবাকে ঢাকায় আনা হয়েছে। ঢাকায় এসেও দুটি হাসপাতাল ঘুরে একটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা পাননি তাঁরা।

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সকাল থেকে সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৪৮ জন সংকটাপন্ন রোগী এ হাসপাতালে ভর্তি হতে আসেন। তাঁদের অধিকাংশই করোনায় আক্রান্ত। প্রত্যেকেরই জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথাব্যথার মতো উপসর্গ ছিল। তাঁদের মধ্যে কেবল ১০ জন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো গেছে। বাকিদের চিকিৎসা দিয়ে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মাজেদ সরদার (৫৫)। জরুরি বিভাগের সামনের বেঞ্চে বসেই তাঁকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে ৫৩-তে এসে ঠেকেছে। চিকিৎসকেরা তাঁকে দ্রুত আইসিইউ সেবা দেওয়ার পরামর্শ দেন। মাজেদ সরদারের ছেলে মো. ইমন প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাবাকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে পারছেন না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যা আছে ২৮৭টি। আর খালি দেখানো হয়েছে ১২টি। তবে শয্যা খালি নেই উল্লেখ করে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় রোগী ভর্তি আছেন ৩২৬ জন। বাকিদের স্ট্রেচার, বেঞ্চে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

সংকটাপন্ন করোনা রোগী এসে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুগদার হাসপাতালে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা নতুন রোগী ভর্তি নিতে পারছি না। নতুন করে এই হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি করা হলে হাসপাতালের অক্সিজেন সঞ্চালন লাইনে চাপ পড়বে। এখন যেসব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকে অক্সিজেন পাবেন না। এ কারণে বাধ্য হয়ে এ মুহূর্তে নতুন রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের শয্যার মিল না পাওয়ার বিষয়ে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, শয্যা ফাঁকা বা পূর্ণ থাকার তথ্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দেওয়া। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানায়। আর যে তথ্য প্রতিদিন অধিদপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, তা ২৪ ঘণ্টা আগের তথ্য।