চোখের পলকেই তাঁরা ‘নাই’ হয়ে গেছেন

ঈদে রায়েরবাজারে করোনায় হারানো স্বজনদের কবরে যাবেন অনেকে।ছবি: প্রথম আলো

ঘরের দেয়ালে ছবির ফ্রেমে অথবা মুঠোফোনের স্ক্রিনে রয়ে গেছে স্বজনদের হাসিমাখা মুখ। করোনায় হারিয়ে গেছে মানুষগুলো। চোখের পলকেই তাঁরা ‘নাই’ হয়ে গেছেন।  

রাজধানীর উত্তরার তানজিনা খানম করোনায় হারিয়েছেন মা-বোন-দুলাভাইকে। বনশ্রীর নাজমুল ইসলাম স্ত্রী-বাবা ও মাকে হারিয়েছেন। খিলগাঁওয়ের মহসীন কবির হারিয়েছেন বাবাকে। হাজারীবাগের মো. শাহীন হারিয়েছেন মাকে। পরিবারের একজনের মৃত্যুরই কোনো সান্ত্বনা হয় না। আর যে পরিবারে কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিক সদস্য মারা গেছেন, সেসব পরিবারে কে কাকে সান্ত্বনা দেবেন।

এই পরিবারগুলোতেও এবার ঈদ এসেছে। তবে এ ঈদ খুশির কোনো বার্তা নিয়ে আসেনি। এই ঈদে কেবলই স্বজনের জন্য চোখের পানি ফেলছেন তাঁরা। কবরস্থানে গিয়ে স্বজনেরা সান্ত্বনা খুঁজছেন। ভয়াবহ করোনা নিয়ে অনেক মানুষই এখনো সচেতন নন। তবে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা বলছেন, করোনা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা তাঁদের জীবনের গল্পগুলো শুনলেই বুঝতে পারবেন।

ওদের মাম্মামকে আমি কোত্থেকে এনে দেব?

দেয়ালে ফ্রেমে ঝুলছে বাবা-মায়ের ছবি। বিছানায় বসে খেলতে খেলতেই ধ্রুব আর রুদ্র যমজ দুই ভাই ডাকতে থাকে—মাম্মাম-পাপা, মাম্মাম পাপা...। পাশ থেকে একজন বললেন, এই যে তোমাদের পাপা তো এখানে। তারপর থেমে গেলেন। কেননা, মাম্মাম তো কোথাও নেই। মাত্র তিন বছর বয়সের কাছাকাছি বয়সের দুই অবুঝ শিশুকে তো আর বলা যায় না, তোমাদের মাম্মাম আর কথা বলবেন না, করোনার থাবায় তিনি চলে গেছেন অন্য এক জগতে। এই মাম্মাম হলেন বেসরকারি ৭১ টেলিভিশনের সহকারী প্রযোজক রিফাত সুলতানা। তিনি গত ১৬ এপ্রিল সকালে মেয়েসন্তানের জন্ম দিয়ে বিকেলে মারা যান। মেয়ে দীর্ঘ ১৮ দিন পর হাসপাতালে থেকে বাড়ি ফিরেছে। রিফাত সুলতানার রুমে দুটি খাটকে একসঙ্গে করে লাগানো। সেই খাটেই ছোট মশারির নিচে ঘুমিয়ে আছে রিফাত সুলতানার রাজকন্যা। যার নাম তিনি রেখেছিলেন হৃদিতা। খাটের এক কোনায় বসে রিফাত সুলতানার মা হাজেরা সিদ্দিকী বললেন, ‘ওদের মাম্মামকে আমি কোত্থেকে এনে দেব? তিনটি অবুঝ শিশুকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে মাকে ছাড়া। এটা দেখেও যদি কেউ না বুঝে, নিজে সচেতন না হয়, তাহলে এই করোনা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। নিজেদেরই সাবধান হতে হবে।’

গোরখোদকদের কাপড় উপহার দেন মহসীন কবির।
ছবি: প্রথম আলো

করোনার থাবায় রিফাত সুলতানা মারা যান ১৬ এপ্রিল। করোনাতেই ৩ মে মারা যান রিফাতের শাশুড়ি। আর ৬ মে মারা যান রিফাতের শ্বশুর। রিফাতের স্বামী ৭১ টেলিভিশনের প্রযোজক নাজমুল ইসলাম বললেন, ‘ঈদের দিন ভোরে আমি আর রিফাত অফিসে চলে যেতাম। অফিস থেকে ফিরে বাবা-মাকে সালাম করার পর আমাদের ঈদ শুরু হতো। এবার তো পরিবারই নেই, ঈদ আর হবে কেমনে?’
বনশ্রীর বাসায় বাবা-মায়ের বিছানায় বসে নাজমুল বললেন, ‘এক মাস আগেও আমাদের ছিল হাসিখুশি পরিবার। বাবা-মা, দুই ভাই, দুই ভাইয়ের স্ত্রী আর সন্তানেরা মিলে আমরা আনন্দে ছিলাম। এখন সব শেষ।

ছোট মশারির নিচে ঘুমিয়ে আছে রিফাত সুলতানার রাজকন্যা।
ছবি: প্রথম আলো

এক মাসের কম সময়ে পরিবারের তিনজন মানুষ হারিয়ে গেল। মা আর রিফাতকে নিয়ে একই সঙ্গে হাসপাতালে দৌড়াতে হয়েছে। প্রথমে দুজনকে এক হাসপাতালে রাখা হলেও পরে রিফাতকে নিয়ে তো কয়েকটি হাসপাতালে দৌড়াতে হয়। মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তাঁকে রিফাতের মৃত্যুর খবর দিতে পারিনি। মারা যাওয়ার আগের দিন শুধু আমাদের মেয়ের ছবি দেখিয়েছিলাম। মা আর বাবা একই হাসপাতালের আইসিইউতে পাশাপাশি বিছানায় ছিলেন। মা যেদিন মারা যান, সেদিন বাবার সেন্স ছিল না। তাই মা মারা গেছেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তারপর তো বাবাও চলে গেলেন।’

রিফাতের মা হাজেরা সিদ্দিকী বলছিলেন, ‘বউ, শ্বশুর–শাশুড়ি যুক্তি করে তিনজন চলে গেছে স্বার্থপরের মতো। আমাদের কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে গেছে। আমরা বেঁচে আছি। আমাদের চেয়ে বয়স্ক অনেক মানুষ বেঁচে আছে, অথচ অপরিণত বয়সে মেয়েটা চলে গেল। মায়ের চোখের সামনে, বাসার নিচে লাশবাহী গাড়ি দেখা, বাপের কাঁধে মেয়ের লাশ, এর চেয়ে কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই। আর কাউকে যেন এমন কষ্ট না দেন আল্লাহ। আমাদের দুটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। শেষ হয়ে গেছে। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’

মাকে হারিয়েছেন তানজিনা খানম। মাকে মনে পড়লে ছবিতেই খোঁজেন সান্ত্বনা।
ছবি: প্রথম আলো

আম্মু তো আর নাই...

বুধবার দুপুরে উত্তরার বাসায় বসে যখন তানজিনা খানমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তিনি একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন। জীবনের ‘ট্র্যাজেডি’র কোন গল্পটি আগে বলবেন, তা–ই ভেবে পাচ্ছিলেন না। করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মা ফোনে বলেছিলেন, মা তানজিনার জন্য সদকা দিয়েছেন। হাসপাতালে বসেই তানজিনা শুনেছিলেন তাঁর মায়ের করোনা পজিটিভ। তাঁকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

তারপর থেকে মায়ের খোঁজ করলেই স্বামী সরকারি কর্মকর্তা সোহেল হাসানসহ অন্যরা শুধু বলতেন, মা ভালো আছেন। আইসিইউ থেকে কেবিনে আছেন। মুঠোফোনে কথা বলতে চাইলে বলতেন, মায়ের সঙ্গে ফোন নেই। সবই বিশ্বাস করেছিলেন তানজিনা। তানজিনা ১০ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন ২২ এপ্রিল। তারপর ২৬ এপ্রিল শরীর যখন একটু ভালোর দিকে, তখন বড় বোন ফোন করে বলেন, ‘তোমার কাছে একটা জিনিস লুকাইছি। আম্মু তো আর নাই।’

তানজিনা বলেন, ‘আম্মু মারা গেছেন ১৪ এপ্রিল। আর আমি তা জানতে পেরেছি ২৬ এপ্রিল। হাসপাতালে আমি ভেবেছি আম্মু হাসপাতালেই আছেন। আম্মুর জন্য দোয়া করেছি, যাতে দ্রুত সুস্থ হন। আর বাসায় ফিরে জানলাম, আম্মু নেই, তিনি মারা গেছেন।

চোখের পলকে মানুষ নাই হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। করোনা এত ভয়াবহ।’
তানজিনার পরিবারে করোনা থাবা বসায় মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। তানজিনা বলছিলেন, ২৫ মার্চ রাতে মেজো বোনের করোনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার কথা ছিল। সেদিন ফোন দিলে মেজো বোনের সঙ্গে কথা হয়। বোন জানিয়েছিলেন, তাঁর শরীর খারাপ, করোনা পজিটিভ। পরের দিন বোনের হাসপাতালে যাওয়ার কথা।

তানজিনা বললেন, ‘পরের দিন সকালে ঘুমাচ্ছিলাম। আমার স্বামী ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, “মেজো আপা তো আর নাই।” এই বোন যেদিন মারা গেলেন, সেখানে গিয়ে বড় দুলাভাই বলেছিলেন, তাঁর জ্বর জ্বর লাগছে। মেজো বোন ২৬ মার্চ মারা গেলেন। আর ২ এপ্রিল বড় দুলাভাই হাসপাতালের লিফটেই মারা গেলেন। আমাদের বাবা নেই, এই বড় দুলাভাই ছিলেন বাবার মতো। সেই অর্থে আমরা আমাদের বাবাকেও হারিয়ে ফেললাম।

পরে শুনেছি, আমাকে ঠিক সময়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে না পারলে আমিও হয়তো মা-বোন-দুলাভাইয়ের তালিকায় যোগ হতাম। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বোনের মেয়েরও করোনা পজিটিভ হয়। ওকে যখন আইসোলেশনে রাখা হয়, তখন ওর মনেও ভয় ঢুকে যায় যে সে–ও মনে হয় বাঁচবে না। প্যানিক ডিজঅর্ডার দেখা দেয়। আল্লাহর রহমতে মেয়েটা বেঁচে আছে, এটাই শুকরিয়া।’

তানজিনা বললেন, বোকার স্বর্গে যারা বাস করছে, তারাই বলছে করোনা বলে কিছু নেই। তানজিনার ছেলের বয়স সাড়ে ৭ বছর আর মেয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর। তানজিনা খানমের স্বামী সরকারি কর্মকর্তা সোহেল হাসানকে শুধু সন্তান সামলানো নয়, শাশুড়ি মারা গেলে সে খবরটাও স্ত্রীর কাছে গোপন করতে হয়েছে, দিনের পর দিন মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে। বললেন, ‘বাসার খণ্ডকালীন গৃহকর্মী সাহস করে রাতে থাকতে রাজি হয়েছিলেন বলে বাচ্চা দুটোকে সামলানো সম্ভব হয়েছে। আমার মায়েরও করোনা পজিটিভ হওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে মাকেও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোনো আত্মীয়কে বাসায় এসে থাকতে বলা যায় না। তাই সব মিলিয়ে কঠিন অবস্থা ছিল। অন্যদিকে স্ত্রীর শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তার মায়ের মৃত্যুর খবর গোপন করতে মাঝেমধ্যে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে। এটা অন্য রকম কষ্ট। এমন অভিজ্ঞতাও জীবনে প্রথম।’

হারানো স্বজনদের জন্য দোয়া করছেন তিনি।
ছবি: প্রথম আলো

কবরস্থানে ছুটে যান সন্তানেরা

রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানের ৮ নম্বর ব্লকে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের কবর। গত মঙ্গলবার বিকেলে বৃষ্টি পড় ছিল। কবরস্থানে গিয়ে দেখা মিলল মো. শাহীনের সঙ্গে। তিনি তাঁর মায়ের কবরের পাশে বসে মোনাজাত করছিলেন। হাজারীবাগ থেকে কবরস্থানের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তাই মন খারাপ লাগলেই তিনি মায়ের কবরের পাশে চলে আসেন। মায়ের কবরের নামফলকে লেখা, ‘আমার মা’।

মায়ের নাম শাহানূর বেগম। তিনি করোনায় মারা গেছেন চলতি বছরের গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। শাহীন তাঁর মায়ের একমাত্র ছেলে। শাহীনের আরও তিন বোন আছেন। শাহীন মায়ের কবরে কাছে আসার আগে কৃষ্ণচূড়ার একটি ডাল ভেঙে এনেছেন। সবুজ ঘাসের ৯৬২ নম্বর কবরের নামফলকের নিচেই ফুল রাখা।

শাহীন করোনায় কাজ হারিয়েছেন। জানালেন, তাঁর মায়ের আগে থেকেই শরীর খারাপ ছিল। তবে মারা যাওয়ার দিনও হাসাহাসি করেন। রাতেও ভালো ছিলেন। তারপর রাত ১২টার দিকে অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালের আইসিইউ খোঁজার জন্য হাসপাতালে ঘুরতে হয়। তারপর আইসিইউ মিললেও মাকে আর ফেরানো যায়নি।

কবরস্থানেই দেখা মিলল বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ মহসীন কবিরের সঙ্গে। তাঁর বাবা মো. রওশন আলী মারা গেছেন ৫ এপ্রিল। বাবাকে ছাড়া মহসীন কবিরদের চার ভাইয়ের এবার প্রথম ঈদ। ঈদের সময় ভাইয়েরা মিলে বাবাকে লুঙ্গি, শার্ট কিনে দিতেন। তিনি খুব খুশি হতেন। ছেলেদের দেওয়া উপহারগুলো পরে বাসায় ঘুরতেন। এবার আর তা হবে না। মহসীন কবীর ও তাঁর অন্য তিন ভাই মিলে বাবাকে ঈদে যেমন পোশাক কিনে দিতেন, সেই একই উপহার নিয়ে এসেছেন রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে। সেখানকার ৩৩ জন গোরখোদকদের হাতে তুলে দিলেন উপহারগুলো। বললেন, বাবা ছাড়া এবার প্রথম ঈদ। বাবা আমাদের দেওয়া পোশাকগুলো পরে ঘুরতেন। এখন তিনি যেখানে শুয়ে আছেন, সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা এসব মানুষ সেই একই পোশাক পরে ঘুরবেন। এতে বাবা হয়তো খুশি হবেন।

করোনা ব্লকে মহসীন কবিরের বাবার কবরের সিরিয়াল ১০৫১ নম্বর। এরপরে আরও অনেক কবর হয়েছে। মহসীন কবির বললেন, ‘করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

করোনার ভয়াবহতা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব না। যে পরিবার স্বজন হারিয়েছে, তারাই বুঝতে পারছে। বাড়ির প্রবীণ সদস্যরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। সবাইকে সাবধান হতে হবে।’

রয়ে গেছে শুধু ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

করোনায় স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা বলছেন, করোনাকাল কিন্তু শেষ হয়নি। সামনে আরও ভয়াবহ দিন আসছে। তাই করোনাকে উপেক্ষা নয়, করোনা থেকে বাঁচতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

নাজমুল, ধ্রুব, রুদ্র, হৃদিতা, তানজিনা, শাহীন বা মহসীনদের জীবন হয়তো জীবনের নিয়মেই চলবে। পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। স্বজন হারানো এই পরিবারগুলোর সদস্যরা সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন, যাতে তাঁরা সামনের কঠিন পথটুকুও পাড়ি দিতে পারেন।