টিকা নিতে সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙতে হলো বয়োজ্যেষ্ঠদের

৯১ বছর বয়স্ক মোহাম্মদ মফিজ ছেলে কামরুল হাসানের সঙ্গে এসেছেন টিকা নিতে। সোমবার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ছবি: দীপু মালাকার

রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা নুরুল হক পাটোয়ারী। ডান পায়ে ব্যথা থাকায় ৯৩ বছর বয়সী এই ব্যক্তি সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না। তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগমের বয়স ৭৫। তাঁরা দুজন আজ সোমবার সকালে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন করোনার টিকা নিতে। কিন্তু হাসপাতালে এসে লিফট বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন। অগত্যা সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে তিনতলায় টিকাদান বুথে আসেন।

সকাল ১০টায় এসে নুরুল হক ও রোকেয়া বেগমের করোনার টিকা নেওয়া ও বিশ্রাম শেষ হয় দুপুর ১২টার দিকে। এই বয়োজ্যেষ্ঠ দম্পতির মেজো ছেলে মোহতাসিম বেলাল বলেন, বাবা-মায়ের করোনা টিকা দেওয়ার জন্য তিনি অনলাইনেই নিবন্ধন করেছেন। তবে হাসপাতালে এসে করোনার বুথ খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছে। লিফট বন্ধ থাকায় তাঁর বাবা-মায়ের ওপরে উঠতেও অসুবিধা হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু বয়োজ্যেষ্ঠদের টিকা দেওয়া হচ্ছে, তাই করোনার বুথগুলো তিনতলায় না করে নিচতলায় করলে ভালো হতো। অথবা টিকা নিতে আসা বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য আলাদা একটি লিফটের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।

এই হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ সোমবার সন্ধ্যায় জানান, হাসপাতালে আজ টিকা নিতে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের চেয়ে নিবন্ধন করা বয়োজ্যেষ্ঠদের চাপ ছিল। তবে হাসপাতালের চারটি লিফটের মধ্যে দুটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই সমস্যা হয়েছে। লিফটগুলো ঠিক করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানান এই পরিচালক।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোমবার সকাল ১০টা থেকে করোনার টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিবন্ধন করা ৫৫ ঊর্ধ্ব বয়োজ্যেষ্ঠরা হাসপাতালে টিকা নিতে হাজির হন। তাঁদের অন্তত আটজন লিফট বন্ধ থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, টিকা নেওয়ার পর তাঁদের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে হাসপাতালে এসে করোনার বুথ খুঁজে নিতে ও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে তাঁদের কষ্ট হয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত গোলাম মূর্তজা মেয়ের সঙ্গে এসেছিলেন টিকা নিতে
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, টিকা নিতে আসা ব্যক্তিদের জন্য হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে কাগজ সেঁটে রাখা হয়েছে। কারও যেন কোনো ঝামেলা না হয়, সে জন্য হাসপাতালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।

৭৩ বছর বয়সী আবুল হাসান মুগদা হাসপাতালে আসেন সকাল সাড়ে ১০টায়। গোপীবাগের এই বাসিন্দার সঙ্গে ছিলেন ৭০ বছর বয়সী স্ত্রী মনোয়ারা বেগম। টিকা নেওয়া শেষে বেলা একটার দিকে করোনা টিকাদানকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ আসনের একটি চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আবুল হাসান। বললেন, ‘লিফট বন্ধ ছিল, ওপরে উঠতে কষ্ট হয়েছে। এই হাসপাতালে সকালে শুরুর দিকে সিরিয়াল মানা হয়নি। তিন ঘণ্টা লাগল এক টিকা দিতে। বসে থাকার দরকার কী, যে কাজ এটা তো তিন ঘণ্টার না।’

৮৪ বছর বয়সী রিজিয়া খাতুনের বাঁ পায়ের হাড় ক্ষয়ে গেছে, সেখানে ব্যথা। এক হাতে লাঠিতে ভর করে তিনি ছেলের সঙ্গে হাসপাতালে টিকা নিতে এসেছেন। নারিন্দা ভূতের গলির এই বাসিন্দাও অভিযোগ করে বলেন, ‘তিনতলায় উঠতে লিফট খোলা পাইনি। লাঠি দিয়ে ভর করে হেঁটে এসেছি। কষ্ট হলেও টিকাটি নিলাম। লিফটের ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো লাগত।’

প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে বলে মুগদা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের ব্যানারে লেখা। তবে টিকাদান শুরু হতে ১০টা বাজে। বেলা দুইটার পর টিকা নিতে আসা আর কেউ থাকেন না।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন ইসমত হায়াত খান ও সালমা খান
ছবি: প্রথম আলো

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল রোববার রাতে নিবন্ধন নেওয়া ৫০০ জনের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছিল। আজ সোমবার টিকা নিয়েছেন ৩৫৪ জন। এর মধ্যে নারী ৯৪ জন। গত শনিবার রাতে ৪৭১ জনকে মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম দিনে টিকা নিয়েছিলেন ৩১৪ জন। এই হাসপাতালে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৪ হাজার ২০০ জন করোনা টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ৩ হাজার জনকে মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে করোনা টিকার সময়সূচি জানানো হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিকার সময়সূচি জানানো হয়েছে।

আজ বেলা ১১টার দিকে মুগদা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলায় করোনার টিকাদান কেন্দ্র। কেন্দ্রে ঢুকতেই অপেক্ষমাণ স্থান যেখানে টিকা নেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে প্রায় ৫৫টি আসন। পুরোটাই মানুষে ভর্তি। সিরিয়াল দিয়ে প্রতি ১০ জন করে বুথে ঢোকানো হচ্ছে। এরপর এন্ট্রি করে স্বেচ্ছাসেবকেরা আটটি বুথে ব্যক্তিদের নিয়ে যাচ্ছেন। টিকা দেওয়া শেষে পর্যবেক্ষণের জন্য চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে হয়।

টিকা দেওয়া শেষে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ৬০ বছর বয়সী নন্দদুলাল চক্রবর্তী ও তাঁর স্ত্রী শিপ্রা চক্রবর্তী। আর কে মিশন রোডের বাসিন্দা তাঁরা। শিপ্রা চক্রবর্তী বলেন, করোনা টিকা নিতে তাঁর কোনো ভয় লাগেনি। তাঁর দুই মেয়ে বিদেশে থাকেন। তাঁরাই অনলাইনে নিবন্ধনের কাজ করে দিয়েছেন। তবে হাসপাতালে এসে করোনার টিকাদান কেন্দ্র খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রের বাইরে সকাল থেকেই একটু ভিড় ছিল। টিকা নিতে ব্যক্তিদের সুবিধার্থে দেয়ালে দেয়ালে এক পাতা কাগজে নির্দেশনা প্রিন্ট করে সাঁটানো হয়েছে। তিনি বলেন, মুঠোফোনে খুদে বার্তা না পেলেও নির্ধারিত দিনে কেউ হাসপাতালে এলে করোনার টিকা পাবেন। টিকা না নিয়ে কাউকে ফেরত যেতে হবে না।