টিকা নেওয়ার পর ১২ জনের করোনা শনাক্ত, একজনের মৃত্যু

গত এক সপ্তাহে উপজেলার ১০৬ জন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৯ জনের শরীরে।

ফাইল ছবি

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর ১২ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এই ১২ জনের মধ্যে ১ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর টিকা নিয়েছেন—এমন এক ব্যক্তির শরীরেও ফের করোনা শনাক্ত হয়েছে। টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত ১২ জনের একটি তালিকা করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ ধরে এখানে করোনা আক্রান্তের হার বাড়ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। এ জন্য মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কিন্তু টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকা যাবে না।

ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেন, করোনার শুরু থেকেই কিশোরগঞ্জকে ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে জেলার শীর্ষে ভৈরব উপজেলা। এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৮৬ জনের নমুনা থেকে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮২৬ জনের। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে শুরু করে। আগস্টে এসে পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

গত মঙ্গলবার ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে উপজেলার ১০৬ জন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৯ জনের শরীরে। অথচ এক মাস আগেও বেশির ভাগ দিনেই আক্রান্তের সংখ্যা থাকত শূন্য। নমুনা দিতে আসা লোকজনের সংখ্যাও ছিল খুবই কম।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, গত ৭ ফেব্রুয়ারিতে গণটিকা গ্রহণ শুরু হওয়ার পর ভৈরবে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৭ হাজার ৮৬১ জন। আর গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৫ হাজার ৪৬১ জন। ভৈরবে টিকাকেন্দ্র করা হয়েছে স্থানীয় ট্রমা সেন্টার হাসপাতালে। আক্রান্ত ১২ জনের সবাই ওই কেন্দ্রে থেকে টিকা নিয়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, টিকা নেওয়ার পর মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম শামিম আহমেদ (৬৭)। তিনি পৌর শহরের ভৈরবপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। শামীম আহমেদ টিকা নেন ৮ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি অসুস্থ বোধ করেন এবং শরীরে কোভিডের উপসর্গ দেখা যায়। ওই দিনই তিনি কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে পরীক্ষার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর করোনা শনাক্ত হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরদিন ওই হাসপাতালে তিনি মারা যান। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বলেন, শামিম আহমেদের উচ্চ রক্তচাপ ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ছিল। মৃত্যুসনদে এই তথ্য উল্লেখ করা আছে। শামিম আহমেদের মৃত্যু নিয়ে ভৈরবের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ভার্চ্যুয়াল সভা করেছেন।

এ ছাড়া ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি টিকা নেওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি সুস্থ হয়েছিলেন বলে দাবি তাঁর।

আর ভৈরব পৌর শহরের পলতাকান্দা এলাকার এক দম্পতি টিকা নেন ৯ ফেব্রুয়ারি।

২২ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) তাঁদের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। এই দম্পতির এক ছেলে ও ছেলের স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছেন। ওই দম্পতির মেয়ে প্রথম আলোকে বলেন, টিকা নেওয়ার পর তাঁর মা–বাবা কয়েকটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন।

ভৈরবের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা খোরশেদ আলম শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের সমস্যা হলো টিকা গ্রহণ করার পর ব্যক্তিটি নিজেকে শতভাগ নিরাপদ ভেবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।’

স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি ভৈরবে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনী জমায়েতগুলোতে প্রচুর মানুষ অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক জমায়েতও নিয়মিত হচ্ছে। মানুষ মাস্কও পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধির কিছুই মানা হচ্ছে না। যার কারণে করোনা আবারও দ্রুত ছড়ানোর শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মজিবুর রহমান বলেন, বলা আছে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার এক মাসের আগে কেউ টিকা নিতে পারবেন না। এখন সমস্যা হয়েছে অনেকে আক্রান্ত হয়েও টিকা নিচ্ছেন। কারণ, শরীরে ভাইরাস প্রবেশের তিন দিনের আগে উপসর্গ দৃশ্যমান হয় না। এই সময়টার মধ্যে নেওয়া ব্যক্তিরা টিকা গ্রহণের পরও পজিটিভ হওয়া স্বাভাবিক। আবার টিকা নেওয়ার পর অনেকে নিজেদের নিরাপদ ভেবে অতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে টিকার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা আমাদের টিকাবিধি না বোঝার।’

করোনাভাইরাস
ফাইল ছবি

ভয় নয়, টিকা জরুরি

সম্প্রতি সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা করোনার টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হন। ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১০ ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ক্লিনিক থেকে তিনি করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জ্বর দেখা দেয়।

তিনি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) যোগাযোগ করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি আইইডিসিআরের স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁর নমুনা সংগ্রহ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইইডিসিআর জানায়, ওই কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত।

টিকা নেওয়ার পরও মানুষ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই কর্মকর্তার আক্রান্ত হওয়ার দুটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে। প্রথমত, তিনি হয়তো আগেই সংক্রমিত ছিলেন, কিন্তু রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। দ্বিতীয়ত, টিকা নেওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে ১৪ থেকে ২১ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। টিকা নেওয়ার পর ও অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগেই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ক্ষেত্রে সেটিও হতে পারে।’

টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আরও দেশে ঘটেছে। ৪ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে বলা হয়েছে, ইসরায়েলে সাড়ে সাত লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৫৩১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনার টিকা নেওয়ার কারণে কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে কোভিশিল্ড টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার ন্যূনতম ১৪ দিন পর থেকে সর্বোচ্চ প্রতিরোধসক্ষমতা তৈরি হয়। এ সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই করোনার টিকা নেওয়ার পরও মাস্ক ব্যবহারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, শরীরে করোনার জীবাণু প্রবেশের পর যদি তাঁরা টিকা নেন, তাহলে সেটা কাজ না–ও করতে পারে। কারণ, ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পর এর সুপ্তিকাল ১৫ দিন। তার আগেই তাঁরা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। টিকার বুস্টিং ডোজ বা দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। তবে কারও যদি নানা শারীরিক সমস্যা বা ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল থাকে, তাহলে তিনি আবারও আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সে সংখ্যা ১০ হাজারে একজন হতে পারে।