টিকার জন্য এক উৎসের ওপর নির্ভরতার খেসারত দিতে হচ্ছে: হোসেন জিল্লুর  

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান
ফাইল ছবি

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, টিকা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রাথমিক উদ্যোগ ছিল অপরিণামদর্শী। একটি উৎসের ওপর নির্ভর করার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। আমাদের ঠেকে শিখতে হয়েছে।

এই অর্থনীতিবিদের পরামর্শ, কারা টিকা পাবে, তা নির্দিষ্ট করা দরকার। পাশাপাশি দরকার এর সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করা। টিকা জোগাড়ের কৌশল নির্ধারণ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের দিকেও নজর দেওয়া দরকার।

‘আন্তর্জাতিক টিকা–বাণিজ্য: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এসব কথা বলেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান। আজ বুধবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল অ্যাফেয়ার্স এ সভার আয়োজন করে।
আজকের সভায় মোট তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেগুলো হলো করোনার টিকাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বর্তমান অবস্থা, টিকা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা এবং করণীয়। তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচকেরা আলাদা করে তাঁদের বক্তব্য দেন।

আলোচনায় উঠে আসে টিকা ঘিরে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি, কূটনীতি, ধনী দেশগুলোর একেপেশে আচরণ, দরিদ্র দেশগুলোর টিকা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন জোট ও তাদের সীমাবদ্ধতা, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার করুণ হাল, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, টিকা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নীতি, ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে করোনা ও এর টিকার প্রভাব, কর্মকৌশল নির্ধারণের বিষয়গুলো।

করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কা সামাল দেওয়ার সময় গত বছরের নভেম্বরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনার টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে বেক্সিমকো ফার্মাকে যুক্ত করে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। দুই দফায় সেরাম ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাঠানোর পর ভারত সরকার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর বেকায়দায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। এতে করে ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া বাংলাদেশের গণটিকাদান কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এখন বিকল্প উৎস থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে। চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়েছে। আলোচনা চলছে রাশিয়া থেকে এক কোটি ডোজ টিকা আনার।

হোসেন জিল্লুর বলেন, করোনা মহামারি মানবজাতির অভিন্ন এক সমস্যা। করোনার টিকা নিয়ে দুটি বাস্তবতা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এক. এ নিয়ে নানা বৈশ্বিক উদ্যোগ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘের উদ্যোগ আছে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে। এ উদ্যোগ চলুক। কিন্তু এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের সক্ষমতার নিরিখে টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ করছে। এখানে নিজের স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। টিকার জন্য নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর বলেন, দেশের সবাই টিকা নিয়ে আগ্রহী নয়, এটা জানা গেছে। সাড়ে ১২ কোটি মানুষের জন্য ২৫ কোটি ডোজের কথা পরে ভাবা যেতে পারে। এখন প্রাধান্য ঠিক করতে হবে আর তা করতে হবে চাহিদার নিরিখে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাধান্য দেওয়া যায়।

টিকার ক্ষেত্রে চাহিদা ঠিক করার পাশাপাশি এটা জোগাড়ের কৌশল এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের দিকেও নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন হোসেন জিল্লুর। সরকার নিজে এবং বেসরকারি খাতকেও টিকা উৎপাদনে সম্পৃক্ত করতে পারে। তবে সবকিছুতেই একটা স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা এবং জাতীয় সক্ষমতার কথা বলেন আরেক আলোচক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক মুজাহেরুল হক। তিনি বলেন, মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে। এর জন্য টিকার বিকল্প নেই। দেশের ৭০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে হবে। আর এ কাজ দ্রুতই করতে হবে। কারণ, আমরা এখনো জানি না টিকার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কত দিন থাকবে। সময় বেশি লাগলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

মুজাহেরুল হক বলেন, ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ টিকা তৈরিতে সক্ষম হচ্ছে। আমাদের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার এ সক্ষমতা ছিল। একে আমরা মৃতপ্রায় করে ফেলেছি। কিন্তু এখনো সময় আছে। নিজেদের টিকা উৎপাদনের দিকে অবশ্যই জোর দিতে হবে।

আলোচনায় উঠে আসে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতার চিত্র। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মাত্র ২১ ভাগ বরাদ্দ ব্যয় করতে পেরেছে। করোনার এই কালে এ চিত্র ভয়াবহ। এই ব্যয়ের মধ্যে আবার ৫০০ টাকার জিনিস ৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনার মতো বিষয় আছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রকৃত ব্যয় ১০ ভাগের বেশি হয়নি।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, সরকার যেমন জনগণের দিকে নজরদারি করে, তেমনি সরকারের ওপর বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর জনগণের নজরদারি বাড়াতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ব্যয়সংক্রান্ত চিত্র তুলে ধরে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কোনো বাজেটেই স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের বেশি যায় না। কিন্তু এই ১ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারে না। এবার যে বরাদ্দ আছে, তা দিয়ে মহামারি মোকাবিলা করা যাবে না। তবে বরাদ্দ বাড়িয়েও লাভ নেই। কারণ, তাদের সক্ষমতার অভাব স্পষ্ট, আর আছে দুর্নীতি। কিন্তু টিকার জন্য অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, স্বাস্থ্য একটি সম্পদ। একটি দরিদ্র পরিবারের একজন সক্ষম মানুষ যদি মারা যান, তবে পুরো পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য উৎপাদনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে। তাই মহামারি ঠেকাতে এ খাতে বরাদ্দের বিকল্প নেই। বাজেটে অনুন্নয়ন খাত প্রাধান্য পায়। স্বাস্থ্যের বাজেটের বড় খরচ অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয়। গবেষণা, উদ্ভাবনে বরাদ্দ নগণ্য।

এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বেড়েছে, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, এখন সরকার টিকার বিকল্প উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা আসছেও। এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, টিকার ব্যবস্থাপনা। কেননা একাধিক টিকা আছে। কোন টিকা কাকে দেওয়া হচ্ছে, এদিকে কঠোর পর্যবেক্ষণ দরকার।

আলোচনার আয়োজক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারী ও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আমির খসরু। তিনি শুরুতেই টিকা নিয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। আমির খসরু বলেন, ‘সবার জন্য টিকা’ কথাটি বলা হচ্ছে বটে কিন্তু বাস্তবতা এ থেকে একেবারেই আলাদা। বাস্তবতা হলো, টিকা কুক্ষিগত হয়ে গেছে কিছু দেশ ও কিছু বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির কাছে। আর এসব কোম্পানি এখন টিকার একচেটিয়া বাণিজ্য শুরু করেছে। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উপাত্ত তুলে ধরে আমির খসরু বলেন, টিকার বাণিজ্যে নতুন ধনিক গোষ্ঠীর জন্ম হচ্ছে। বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন অস্ত্র হয়ে উঠছে টিকা।