টিকায় আগ্রহ, ভয় অসত্য–অর্ধসত্য–ভুল তথ্যে

প্রতীকী ছবি

ফেরদৌস খানের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় মেসে থাকেন। পাড়ায় পাড়ায় মুরগি বিক্রি তাঁর পেশা। তিন মাস ধরে কাঁঠালবাগান এলাকায় মুরগি বিক্রি করেন।

গত শুক্রবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফেরদৌস খানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের মুরগির দামের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ ও করোনার টিকা নিয়ে কথা হয়। জানালেন ঢাকাতে তিনি ও গফরগাঁওয়ে তাঁর পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। ‘আপনি কি করোনার টিকা নিতে চান?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে ফেরদৌস খান বলেন, ‘ক্যান নিব না? সরকার টিকা দিলে তো অবশ্যই নিব।’

পাশেই মুদির দোকান। দোকানের মালিক মো. আল মামুনকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকার টিকা দিলে নেব। বিক্রি করলে নেব না।’ টিকা কেন নেবেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মামুন বলেন, সারা দুনিয়ার মানুষ টিকা নেবে। মামুনের বিশ্বাস টিকা নিলে করোনার সংক্রমণ হবে না।

এই দুজন টিকা নিতে চাইলেও টিকার ব্যাপারে আগ্রহ কম ধানমন্ডির গৃহিণী রওনক তানভীরের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী উচ্চবিত্ত পরিবারের এই গৃহিণী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনই টিকা নেব না। আমি দেখব। দেশে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার ২ থেকে ৩ মাস পরে টিকা নেব।’ আপনি কী দেখতে চান, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পর মানুষের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, তা দেখব, এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই টিকা নেব।’ রওনক তানভীর আরও বলেন, তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও দেখে-বুঝে টিকা নিতে চান।

করোনা মহামারির এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনার টিকা। মানুষ এতকাল অপেক্ষা করেছিল টিকার জন্য। কিন্তু সব মানুষ টিকা নেবেন কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হতে দেখা গেছে। অসত্য, অর্ধসত্য ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

আমি এখনই টিকা নেব না। আমি দেখব। দেশে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার ২ থেকে ৩ মাস পরে টিকা নেব
রওনক তানভীর, গৃহিণী

করোনা সংক্রমণ নিয়েও এমন ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। বাংলাদেশও তার বাইরে ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৬টি গুজবের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন টিকা নিয়েও গুজব রটতে পারে।

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পরপরই গুজব প্রতিহত করার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা উদ্যোগ নেয়। তারা তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে সঙ্গে নেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এই কাজে তাদের সহায়তা করছে। গুজবের উৎস সন্ধান ও গুজব রটনাকারীকে শনাক্ত করার কাজ বাংলাদেশেও হচ্ছে বলে গত বৃহস্পতিবার এক ভার্চ্যুয়াল সভায় বলেছিলেন ইউএনডিপির দেশীয় পরিচালক সুদীপ্ত মুখার্জি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এই সভার আয়োজন করেছিল।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল টিকার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কতখানি তা নিয়ে একটি জরিপের সঙ্গে জড়িত। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, টিকা নিতে মানুষ আগ্রহী। কিন্তু টিকার ওপর আস্থা রাখতে আরও সময় লাগবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর মানুষের অজানা।

কোন টিকা কত দিন সুরক্ষা দেবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। এসব অনিশ্চয়তা থেকে সন্দেহ তৈরি হয়। সন্দেহ থেকে অনেকের মনে টিকার ব্যাপারে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। অনেকের টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা কী সিদ্ধান্ত নেন, তার ওপর। টিকার দাম বা টিকা কোন দেশে তৈরি, এসব তথ্যও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।

শনিবার থেকে ভারতে টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার কথা। তবে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে লোকাল-সার্কেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গিয়েছিল ৬৯ শতাংশ টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধায় ছিলেন। বাংলাদেশে এই ধরনের জরিপ হয়নি। একটি জরিপ হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

দেশে করোনার টিকার ব্যাপারে মানুষকে তথ্য দেওয়া এবং টিকার ব্যাপারে আস্থা গড়ে তোলার যোগাযোগ কৌশল ও যোগাযোগসামগ্রী তৈরির কাজে যুক্ত আছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন। মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নানা ধরনের বৈরিতা আছে।

প্রত্যেকেই নিজের টিকাকে অন্যের টিকার চেয়ে ভালো বলে প্রচার করার চেষ্টায় লিপ্ত। অন্যের টিকাকে খাটো করে দেখানোর প্রচেষ্টাও আছে। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। সেই বিভ্রান্তির খবর নানাভাবে এ দেশের মানুষের কাছেও পৌঁছাচ্ছে।

টিকা নিতে মানুষ আগ্রহী। কিন্তু টিকার ওপর আস্থা রাখতে আরও সময় লাগবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর মানুষের অজানা।
আবু জামিল ফয়সাল

মুশতাক হোসেন বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ইতিমধ্যে টিকাদানবিষয়ক প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। প্রশিক্ষণ নির্দেশিকায় টিকার ব্যাপারে ঠিক তথ্য দেওয়ার কথা বলা আছে। করোনার টিকার বিষয়ে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করে যেন চটজলদি উত্তর পেতে পারেন, তার আয়োজন করা হচ্ছে। কিছু নতুন বার্তা তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। টিকাবিষয়ক বার্তা সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা শুরু হবে টিকাদান শুরু হওয়ার আগে আগে। ব্যানার, লিফলেট, পোস্টার ব্যবহারের পরিকল্পনাও আছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআইয়ের মাধ্যমে বহু বছর ধরে এ দেশের শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকার সুফল মানুষ পাচ্ছে। টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই। দেড় সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ টিকাবান্ধব দেশ। করোনার টিকার ক্ষেত্রেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

দেশের কত মানুষ করোনার টিকা নিতে আগ্রহী, কত মানুষ আগ্রহী নয় বা কত মানুষের করোনার টিকার ব্যাপারে দ্বিধা বা সন্দেহ আছে, তা জানা না গেলেও সব মানুষের টিকা নেওয়া দরকার বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন সভাকক্ষে আয়োজিত করোনার টিকাবিষয়ক সংলাপে এই ওষুধ বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, সবাই টিকা না নিলে টিকা দেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হবে না। সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাবে। দ্বিধা থাকলে তা দূর করতে হবে।