ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখতে কড়াকড়ি, ট্রেনও বন্ধ

  • ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে আরও ৭৬ জনের মৃত্যু।

  • মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭ জন খুলনার।

  • নতুন করে ৪ হাজার ৮৪৬ জনের করোনা শনাক্ত।

বিধিনিষেধে বন্ধ আছে দূরপাল্লার বাস চলাচল। এতে ঢাকার বাইরে যাতায়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় মানুষকে। অনেকেই হেঁটে, রিকশায়, পিকআপে করে গন্তব্যে রওনা দেন। গতকাল বেলা একটায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার সেতুতে।
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ অবস্থায় রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন রাখতে বাস ও লঞ্চের পর এবার বন্ধ করে দেওয়া হলো ট্রেন চলাচল।

মানুষ যাতে রাজধানী থেকে বের হতে বা প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে কড়া অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দূরপাল্লার ও আন্তজেলা বাস চলতে দেওয়া হয়নি। সদরঘাট থেকে লঞ্চও ছেড়ে যায়নি। দিনে কিছু ট্রেন ছেড়ে গেছে, যেগুলো লকডাউনে থাকা সাত জেলায় থামেনি। এরপর রাতে ঘোষণা আসে যে রেল চলাচলও বন্ধ থাকবে। সেটা কার্যকর হয়েছে গতকাল মধ্যরাত থেকেই।

সব মিলিয়ে এক দিন, দুই দিন নয়, মোট নয় দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল রাজধানী। ঘোষণা অনুযায়ী, ৩০ জুন পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।

বাস-লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন কাজে ঢাকায় আসা ও ঢাকার বাইরে যাওয়া মানুষ বিপাকে পড়েছেন। যাঁরা রাজধানীতে থাকেন, কিন্তু কাজ করেন ঢাকার আশপাশের শিল্পঘন এলাকাগুলোর কারখানায়, তাঁদেরও ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার অনেকে ঢাকার আশপাশে থাকেন, কিন্তু কর্মস্থল রাজধানীতে, তাঁদেরও দুর্ভোগের কোনো শেষ ছিল না।

যেমন গতকাল সকালে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাস পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়েছিলেন আসিফ ইকবাল। তিনি সুপরিচিত একটি শিল্পগোষ্ঠীর মেঘনা ঘাটের কারখানায় কাজ করেন। তিনি বলেন, বাস বন্ধ। কিন্তু কারখানায় যেতেই হবে। বাসে ভাড়া লাগত ৪৫ টাকা। এখন মোটরসাইকেলে ভাড়া চাইছে ৩০০ টাকা।

আসিফ কর্মস্থলের উদ্দেশে রাজধানীর বাইরে যেতে চান। আর নিবাস চন্দ্র দাশ দুই মাস বয়সী সন্তানকে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসক দেখানো শেষে বাড়ি ফিরতে চান। তাঁর বাস কুমিল্লার রূপসীতে। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে তিনি এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে দুই মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু হেঁটে পার হচ্ছিলেন।

নিবাস চন্দ্র দাশ পেশায় নরসুন্দর। তিনি বলেন, ঢাকায় থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাড়ি ফিরতেই হবে। দোকান খুলতে হবে। বাস না পেয়ে রিকশায় অনেকটা পথ গিয়ে হাঁটা শুরু করেছেন। সামনে কোনো যানবাহন পেলে তাতে উঠবেন।

ঢাকার চার পাশের জেলায় ‘লকডাউনের’ প্রথম দিন রাজধানী থেকে বাস ও লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। পথে মানুষের ভোগান্তি।

করোনা সংক্রমণ বাড়ছে

এদিকে করোনা সংক্রমণও বাড়ছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মোট ২৫ হাজার ২৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮৪৬ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৭ জন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। ঢাকা ও রাজশাহীতে মারা গেছেন ১৪ জন করে। বাকিরা অন্যান্য বিভাগের।

বিপরীতে ঢাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু আগের তুলনায় কম। এ অবস্থা রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন রাখতে গত সোমবার হঠাৎ করেন আশপাশের চারটিসহ সাত জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা কার্যকর হয়েছে গতকাল সকাল থেকে। এই সাত জেলা হলো মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জ। এ জেলাগুলো দিয়ে যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ফলে ঢাকা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন নিষেধাজ্ঞার বাইরে শুধু উড়োজাহাজ।

বাস টার্মিনালে মানুষ

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গতকাল ভোর থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি। যদিও অনেকেই বাসের জন্য টার্মিনালে ভিড় করেন। বেশির ভাগের দাবি, তাঁরা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানতেন না। অনেকে জরুরি প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য বের হয়েছেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাইনবোর্ড এলাকায় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, সড়কে শত শত মানুষ। কেউ ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে, কেউ বাসের কাউন্টারে বসা, কেউ ট্রাক-পিকআপ দেখলেই থামার ইশারা করতে ব্যস্ত। বাস না থাকলেও অনেকেই মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশা ও ট্রাকে চড়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছোটেন। রাস্তায় দু-একটি মিনিবাসকেও যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়।

সাইনবোর্ড এলাকায় সকাল থেকেই সড়কের দুই পাশে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নিয়ে মানুষের চলাচল আটকানোর চেষ্টা করেন। নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত সূত্রধর বলেন, যেসব গাড়ি জরুরি কারণ দেখাতে পারছে না, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মিনিবাস ও পিকআপে মানুষ পরিবহনও নিষিদ্ধ। তবু মানুষ যাচ্ছে। জনবলসংকটের কারণে পুরো নজরদারি সম্ভব হচ্ছে না।

সায়েদাবাদের মতো গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে গতকাল কোনো বাস ছাড়েনি। টার্মিনালে বাসের টিকিট কাউন্টারগুলো বন্ধ ছিল। আমিনবাজার ও আবদুল্লাহপুরে পুলিশের কড়াকড়ি দেখা যায়। বাস না চলায় পোশাকশ্রমিকদের অনেকে কর্মস্থলে যেতে ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকেই হেঁটে কারখানায় যান।

বাড়তি ব্যয়

সকাল সাড়ে ১০টায় গাবতলী বাস টার্মিনালে কথা হয় মো. আল আমিনের সঙ্গে। স্ত্রী শাবানা আক্তার, শ্যালক বিপ্লব মিয়া ও আট মাস বয়সী ছেলে আরাফাতকে নিয়ে তিনি সিরাজগঞ্জ যাবেন। গত সোমবার রাতে তাঁরা নোয়াখালী থেকে লঞ্চে ঢাকায় আসেন। আল আমিন বলেন, ‘সকালে সদরঘাটে পৌঁছে জানতে পারি দূরপাল্লার বাস চলবে না। ট্রেন ধরতে কমলাপুরে গিয়েছিলাম। কিন্তু টিকিট পাইনি। এরপর গাবতলী আসি।’

ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর আল-আমিন দেড় হাজার টাকায় একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করেন। সেটিতে চড়ে পরিবারসহ আরিচা ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেন। এর আগে তিনি বলেন, বাস না থাকায় তিন গুণ ভাড়া দিতে হচ্ছে।

রেল চলাচলও বন্ধ, লঞ্চঘাটে যাত্রী

কমলাপুর রেলস্টেশনে গতকাল যাত্রীদের বেশ ভিড় দেখা গেছে। জরুরি প্রয়োজনে অগ্রিম টিকিট কাটতে গিয়েছিলেন অনেকে। স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার বলেন, অধিকাংশ আন্তনগর ট্রেনের ২৫ জুন পর্যন্ত টিকিট বিক্রি শেষ।

তবে রাতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকায় কোনো ট্রেন ঢুকবে না, বেরও হবে না। তবে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুরের পথের ট্রেন চলাচল করবে।

ঢাকা থেকে সারা দেশে সব ধরনের যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল বন্ধের পর গতকাল সদরঘাট থেকে অনেক যাত্রীকে ফিরে যেতে হয়। গাজীপুরের জিরাবো থেকে আসা তাসলিমা বেগম বলেন, ‘আমি বরগুনা যাব। সদরঘাটে এসে শুনি লঞ্চ চলাচল বন্ধ।’

‘সংসার কীভাবে চলছে, কেউ খোঁজ নেয় না’

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দেশে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ। ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে বাস ও লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন শ্রমিকেরা। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

আলম এশিয়া পরিবহনের কর্মী মনোয়ার হোসেন গতকাল মহাখালী বাস টার্মিনালে অলস বসে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পরপর সরকার বাস চলা বন্ধ করে দেয়। দেড় বছর ধরে সংসার কীভাবে চলছে, সে খোঁজ তো কেউ রাখে না।’