তাৎক্ষণিক নিবন্ধন নিয়ে হিমশিম

বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারে টিকা দিতে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের জন্য লাইন
ছবি: প্রথম আলো

অবসরপ্রাপ্ত নার্স ফ্লোরা মায়া রায় করোনা টিকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারেননি। তাঁর ভাষায় তিনি প্রযুক্তি কম বোঝেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টিকা নেওয়ার জন্য ফরম পূরণে তিনি মুঠোফোনে বার্তা পেলেও তা পূরণ করতে পারেননি।

খবরে দেখেছেন, টিকাদানকেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকা নেওয়ার সুযোগ আছে। তাই আজ বুধবার সকাল ৯টার দিকে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কনভেনশন সেন্টারে টিকা নিতে এসেছেন। কিন্তু এসে দেখেন বিশাল লাইন।

সকাল ১০টার দিকে লাইনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত নার্সিং সুপারভাইজার ফ্লোরা মায়া। ঠিক ওই সময় রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক দলের টিম লিডার নাফিজ কালাম হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন, বেলা ২টা পর্যন্ত তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করা ৫০ জনকে শুধু টিকা দেওয়া হবে। পরে লাইনে দাঁড়ানো ৫০ সিরিয়াল নম্বর পর্যন্ত টোকেন দেওয়া হয়। ঘোষণা শুনে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অনেকেই ফিরে গেলে দীর্ঘ লাইনটি অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ছোট হয়ে যায়।  

ঘোষণা শুনে বিমর্ষ হয়ে যান কলাবাগানের বাসিন্দা নুরুন্নাহার (৮০)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বড় ছেলে ৬ ফেব্রুয়ারি কানাডায় মারা গেছেন। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ছেলের কাছে যাচ্ছেন। তাঁর ফ্লাইট ২০ ফেব্রুয়ারি। মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে টিকা নিতে চেয়েছিলেন। ঘোষণা শোনার পর বাসায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ঘণ্টাখানেক পর ওই লাইনের কাছে আবার এসে নুরুন্নাহারকে আর দেখা যায়নি। লাইনে দাঁড়ানো অন্য লোকজন জানালেন, তিনি টিকা না নিয়েই চলে গেছেন। তবে টোকেন না পেয়েও অবসরপ্রাপ্ত নার্স ফ্লোরা মায়া রায় লাইনে রয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, লোক কম হলে আজ টিকা নেওয়ার সুযোগ পেলেও পেতে পারেন।

ই ভরসাতেই দাঁড়িয়েছিলেন। একই ভরসায় টোকেন না পেয়েও দাঁড়িয়েছিলেন হাইকোর্টের আইনজীবী মোক্তার হোসেন সুজন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী ফারুক খান। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার পর ফারুক খান জানালেন, তিনি ও মোক্তার হোসেন বেলা সোয়া ২টায় টিকা নিতে পেরেছেন। ফ্লোরা মায়া মুঠোফোনে জানান, তিনি টিকা নিতে পেরেছেন দেড়টার দিকে। ওটা ছিল শেষ ভায়েল (ভায়েলের পরিমাণের ওপর নির্ধারিত হয় কতজন টিকা নিতে পারবেন। এক ভায়েলে ১০ জনকে টিকা দেওয়া যায়। একজনের এক সিসি পরিমাণ ওষুধ লাগে।) তিনি শুনেছেন, তেজগাঁও থেকে নতুন ভায়েল আনা হচ্ছে। টিকা দেওয়ার পর তাঁকে আধঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না, বোঝার জন্য।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের জন্য তেমন লাইন নেই
ছবি: প্রথম আলো

বিএসএমএমইউ টিকাদানকেন্দ্রে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনে এমন হিমশিম অবস্থা দেখা গেলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত টিকাদান কেন্দ্রে ছিল উল্টো চিত্র। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সেখানে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করেছেন ৩৭ জন। কোনো ভিড় ছিল না। তাৎক্ষণিক টিকা নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স রেজাউল করিম প্রথম আলোকে জানান, গতকাল বেলা ২টা পর্যন্ত ৭৮০ জনের মতো টিকা নিয়েছিলেন ওই কেন্দ্র থেকে। এর মধ্যে ৪৮ জন তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করেছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুজন চিকিৎসক সোহানা মাকসুদ ও সৌরভ দাস আজ তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা জানান, বয়স ৩০ বছর হলেও সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে অগ্রাধিকার থাকায় তাঁরা টিকা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

বিএসএমএমইউর একজন কর্মকর্তা জানান, গতকাল অনেক বেশিসংখ্যক মানুষকে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনে টিকা দেওয়া হয়েছিল বলে আজ আরও বেশি লোক এসেছেন।
এলিফ্যান্ট রোড থেকে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকা দিতে এসেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৬২) ও কামরুন্নাহার (৫৫) দম্পতি। তাঁরা টোকেন নম্বর (৩৮, ৩৯) পেয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কামরুন্নাহার বললেন, তাঁর স্বামী অনলাইনে নিবন্ধন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানের চেয়ে এখানে নিরাপদ মনে করায় এসেছেন।

নিবন্ধনে ভিআইপি-নন ভিআইপি

বিএসএমএমইউর টিকাদান কেন্দ্রে ভিআইপিদের জন্য তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আজ সেখানে প্রবীণদেরই বেশি দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক নিবন্ধনে যত বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল, সেটা ভিআইপিতে একেবারেই ছিল না। অপেক্ষমাণ চেয়ারে তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন।

বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যাঁদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই বা যাঁরা অনলাইনে ফরম পূরণ করতে পারেন না, তাঁদের জন্য তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যাঁরা পারেন তাঁদের নিবন্ধন করে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

বিএসএমএমইউর টিকাদান তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুজন কর্মকর্তাকে। এর একজন সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম টিকাদানকেন্দ্রে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল টিকা নিয়েছেন ১ হাজার ৪৯৭ জন। এর মধ্যে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করে টিকা নিয়েছেন সাড়ে ৪০০-র মতো। এর মধ্যে ভিআইপি ছিলেন তিন শতাধিক। তিনি বলেন, পরশু রাতে ঘোষণা থাকায় তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের জন্য কাল অনেক মানুষ টিকা নিতে এসেছিলেন। একজনের পেছনে নিবন্ধনে সময় দিতে হয় ১০ মিনিটের মতো। এত কম লোকবল দিয়ে এটা করা কঠিন। গতকাল সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আজ ভিআইপি ২০০ আর সাধারণ ৫০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। অনেকেই আজ এসে নিবন্ধন করতে না পেরে হইচই করেছেন। কিন্তু সক্ষমতাও তো থাকতে হবে। আজ মোট ১২০০ জনকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে বিকেলে শফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, ১ হাজার ৮৩৪ জনকে তাঁরা টিকা দিয়েছেন। এর মধ্যে কতজন ভিআইপি তাৎক্ষণিক টিকা নিয়েছেন, সে হিসাব এখনো করা হয়নি।

এ ছাড়া রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ও শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সেখানে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন নয়, ফরম পূরণ করে আসা ব্যক্তিদেরই টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন কর্মী জানান, বিশেষ প্রয়োজন থাকলে কাউকে কাউকে তাঁরা তাৎক্ষণিক নিবন্ধন করতে দিচ্ছেন।

সেখানে সকাল সাড়ে ৯টায় উপস্থিত নিকেতনের বাসিন্দা মনজু আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, আজ তাঁকে জরুরি প্রয়োজনে মুন্সিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে। এর আগে টিকা দেওয়ার জন্য গতকাল হাসপাতালে এসেছিলেন। তবে ২টা বেজে যাওয়ায় তাঁর নিবন্ধন হয়নি। আজ সকাল সাড়ে ৭টায় এসেছেন। সাড়ে ৯টায় নিবন্ধন করতে পেরেছেন। তবে টিকা দিতে পারবেন কি না, জানেন না। তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।