দ্বিতীয় ডোজের স্বল্পতা, টিকাকেন্দ্রে অসন্তোষ

দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন ২৩ লাখের বেশি মানুষ। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে আছে ৮ লাখের কিছু বেশি টিকা।

করোনা টিকা
প্রতীকী ছবি

টিকার প্রথম ডোজ পাওয়া ১৫ লাখের বেশি মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। তাঁরা দ্বিতীয় ডোজ কবে পাবেন, তা স্পষ্ট করতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। এদের একটি অংশ গতকাল রোববার চট্টগ্রামে টিকাকেন্দ্রে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গতকাল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯০০ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩৪ লাখ ৯৬ হাজার ১৮৬ জন। দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষায় আছেন ২৩ লাখ ২৩ হাজার ৭১৪ জন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে আছে ৮ লাখের কিছু বেশি টিকা।

প্রথম ডোজ পাওয়া কত মানুষ দ্বিতীয় ডোজ আপাতত পাবেন না, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। ৫ মে সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ১৪ লাখ ৪০ হাজার মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

অসন্তোষ চট্টগ্রামে

উপজেলা ও জেলা শহরের সরকারি হাসপাতালসহ সারা দেশে প্রায় এক হাজার কেন্দ্রে প্রতিদিন টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক কেন্দ্রে টিকার মজুত কমে আসছে। খুলনা জেলার একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রথম ডোজ দেওয়া সব মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া সম্ভব হবে না।

দেশের অন্যতম বড় টিকাকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০ মে পর্যন্ত টিকা দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নতুন টিকা সরবরাহ না করলে প্রথম ডোজ পাওয়া প্রায় ৮ হাজার মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া সম্ভব হবে না।’

এই পরিস্থিতি প্রায় সারা দেশে। এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। প্রথম আলোর চট্টগ্রামের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সকাল থেকে টিকা নিতে আসা মানুষের ভিড় ছিল। টিকার স্বল্পতার কারণে সবাইকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়। তারপরও মানুষ ভিড় করেছিলেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকার সংকট রয়েছে। আজ (সোমবার) দেওয়ার জন্য আমরা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে ১০০ ভায়াল এনেছি। তাতে এক হাজার মানুষকে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু যাঁদের মোবাইল ফোনে কোনো এসএমএস যায়নি, তাঁরাও টিকা নিতে ভিড় করছেন। এখন আমি তো তাঁদের দিতে পারব না।’

চট্টগ্রাম শহরের একাধিক কেন্দ্রে দেখা গেছে, টিকা ফুরিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় এসএমএস ছাড়াই অনেকে টিকা নিতে আসছেন। সিটি করপোরেশন মোমেন জেনারেল হাসপাতালে সকাল থেকে হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে হাতাহাতি শুরু হয়। কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ায় বেলা ১১টার দিকে ১৫ মিনিটের জন্য সড়ক অবরোধ করেন টিকা নিতে আসা মানুষ। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকার সংকট আছে। এখন রেশনিং করে দেওয়া হচ্ছে। যাঁদের মোবাইল ফোনে এসএমএস যায়নি, তাঁদের টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে কিছু মানুষ হট্টগোল শুরু করেছে। তাই আমাদের পুলিশ ডাকতে হয়েছে।’

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ১২ সপ্তাহ পরেও দেওয়ার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এ ব্যাপারে আমরা কারিগরি পরামর্শক কমিটির মতামত নেব।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম, পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা

কত টিকার ঘাটতি

ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ৩২ লাখ এবং কেনা ৭০ লাখ মিলিয়ে মোট ১ কোটি ২ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে এসেছে। গতকাল পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৬ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯১৪ ডোজ টিকা থাকার কথা। বাস্তবে হাতে আছে আরও কম।

টিকা দেওয়ার সময় কিছু টিকা স্বাভাবিকভাবেই নষ্ট বা অপচয় হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা বলেছেন, সাধারণত কোনো টিকাদান কর্মসূচিতে ১০ শতাংশ অপচয়কে গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। তবে এই টিকার ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে।

একটি ভায়ালে ১০ ডোজ টিকা থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি ভায়ালের তরল টিকা ১০ জনকে ভাগ করে দেন। কেউ ১০ ডোজ দিতে পারেন, কেউ পারেন না। আবার এমনও হয় যে একটি ভায়াল খোলার পর তিনজনকে দেওয়া হলো। বাকি সাত ডোজ দেওয়ার মতো মানুষ টিকাদানকেন্দ্রে উপস্থিত থাকে না। তা হলে সাত ডোজেরই অপচয় হয়।

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএসএমএমইউর টিকাকেন্দ্রে দুজন টিকাদানকারী স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, প্রতিটি ভায়াল থেকে ১০ ডোজ টিকা দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, অপচয় ১ শতাংশ বা তার কম হবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিভিল সার্জন বলেছেন, ৪ থেকে ৩ শতাংশ ডোজ অপচয়ের হিসাব বিবেচনায় রাখতে হবে।

কী পরিমাণ টিকা অপচয় বা নষ্ট হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা কমিটির প্রধান অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কোনো জায়গায় অপচয় খুব নগণ্য হয়েছে, কোনো জায়গায় হয়তো একটু বেশি। সার্বিকভাবে অপচয় বা নষ্ট ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়।

দেশে আসা মোট টিকার ১ শতাংশ অপচয় হলে দ্বিতীয় ডোজ টিকা না পাওয়া মানুষ বাড়বে আরও ১ লাখ। ২ শতাংশ নষ্ট হলে এই সংখ্যা ২ লাখের বেশি হবে। সে ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হিসাবে ১৫ লাখের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাওয়া ঝুলে থাকছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ১২ সপ্তাহ পরেও দেওয়ার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এ ব্যাপারে আমরা কারিগরি পরামর্শক কমিটির মতামত নেব। মতামত পেলে আমরা দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার জন্য বাড়তি চার সপ্তাহ সময় পাব। এ ছাড়া টিকা সংগ্রহের জোর তৎপরতা চলছে।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রাম প্রতিনিধি প্রণব বল]