‘দ্যাশ-গেরাম ঢাকার চাইতে বেশি নিরাপদ’

মহামারির সময়ে গ্রামমুখী মানুষের ঢল। কি আত্মঘাতী, নাকি অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে যৌক্তিক আচরণ? এটা কি পলায়নযাত্রা, নাড়ির টান, নাকি সামাজিক মোকাবিলার প্রস্তুতি?

ঈদে বাড়ি ফিরতে ঘরমুখী মানুষের ঢল। ঘাটে ফেরি আসার খবরে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা ফেরির দিকে দৌড় দেয়। গতকাল দুপুরে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে
ছবি: দীপু মালাকার

ঈদের আগে আগে ঢাকায় ভোর হয়, আর কিছু মানুষ পথে বের হয়। এই পথের এক পায়ে ভয়, আরেক পায়ে আনন্দ। আনন্দ এই যে ‘বাড়ি যাচ্ছি, বাড়ি যাচ্ছি’। আর ভয়? বাস বন্ধ, কীভাবে ঘাটে যাব? ঘাটে ফেরি বা ট্রলার না পেলে কীভাবে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পার হয়ে বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছাব? এমন কষ্টমেশানো আনন্দের পথের যাত্রীদের একজন রায়হান। সায়েদাবাদ থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে মাওয়া ঘাটের মোড়ে এসে কেবল পৌঁছেছেন। তখন দুপুর ১২টা। করোনার ভয় নিয়েও কেন বাড়ি যাচ্ছেন?

১৯-২০ বছর বয়সী ছেলেটার মুখে অসহায়ত্বের কষ্ট। কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ‘মায়ে স্ট্রোক করছে, আমারে যাইতেই হবে’। এদিকে ভাড়ার মোটরসাইকেল তাঁকে ছাড়ছে না। ২০০ টাকার ভাড়া ৫৬০ টাকা দেওয়ার পরেও মোটরসাইকেলঅলা মানছেন না। তাঁর দাবি ৮০০ টাকা। কোনোমতে তাঁকে সেখান থেকে ছাড়ানো গেল।

সুখী মানুষ সকলে একরকম, দুঃখীদের দুঃখের বহু কারণ। রায়হান ঢাকার এক কারখানার শ্রমিক। কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে মায়ের অসুস্থতার খবর। ফেরি বন্ধ শুনে রায়হান রওনা হলো ট্রলার ঘাটের দিকে। সেখানে নদীতীরে গুচ্ছ গুচ্ছ যাত্রী, আর ট্রলারগুলো মাঝনদীতে। যাত্রীরা হাতের ইশারায় ট্রলার ডাকে। কোনো লাভ হয় না। কী কারণ? পুলিশ কোনো ট্রলার ভিড়তে দিচ্ছে না। রায়হান তবু নদীর পাড়ে যায়, তাকিয়ে থাকে ওপারের দিকে। ওপারে, তারপর সেখান থেকে আরও দূরে, বরিশালে তাঁর বাড়ি। অন্য সময় লঞ্চে যেত, এবার সে উপায়ও বন্ধ।

‘আমরা করোনার চাইতেও শক্তিশালী’

ঘাটের কাছে পর্দাঘেরা চায়ের দোকানে বেশ কজন নারী-পুরুষ বসা। করোনাকে ভয় পান না? বলামাত্রই মাস্কের আড়াল থেকে একজন আবৃত্তির ঢঙে শুরু করলেন, ‘আমরা করোনার চাইতেও শক্তিশালী। করোনার এমন কোনো শক্তি নাই, যা আমাদের পরাজিত করতে পারে। এই অদৃশ্য শক্তি আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’ মাস্কের আড়ালে তাঁর হাসি দেখা না গেলেও আওয়াজ পাওয়া গেল। তাঁকে সমর্থন করলেন আরেক যাত্রী, ‘মন্ত্রী গত বছর যা বলেছেন, সেটা একেবারে রাইট। করোনা অদৃশ্য শক্তি, আমরা অদৃশ্য শক্তিকে জয় করতে পারব।’

বললাম, ‘কিন্তু জীবন গেলে তো যাবে আপনার বা আপনার পরিবারের। তারপরও কেন ঝুঁকি নেবেন?’ বেঞ্চে বসা আরেকজন গলায় ঝাঁজ মিশিয়ে বললেন, ‘এই যে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়। যানবাহন নাই। এতে কি ঝুঁকি বাড়ল না কমল। সরকার তো পারত বাড়ি যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করতে। পারত না? বাস চললে গ্যাদারিং (ভিড়) আরও কম হতো। করোনার ছড়াছড়ি কম হতো।’

চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের আবদুল্লাহ নিজ থেকেই বলা শুরু করলেন, ‘আমরা বেশির ভাগ ঢাকায় একা থাকি। আমাদের বিবি-বাচ্চা, বাবা-মা বাড়িতে। ঢাকায় ঈদের সময় একা থাকা যায়? কী খাব? যাঁরা ঢাকায় থাকতে বলেন, তাঁরা তো বারো মাসের চৌদ্দ মাসই ঢাকায় থাকেন। তাঁরা তো ঢাকার ব্যাচেলর লাইফের কষ্ট বুঝবে না।’

‘ঢাকায় কে কার?’

মানুষ বলতে থাকে, ‘দ্যাশ-গেরাম ঢাকার চাইতে বেশি নিরাপদ। ঢাকায় পা ফেলার জায়গা নাই, গ্রাম অনেক পাতলা পাতলা। গ্রামে বিপদে-আপদে আত্মীয়স্বজন পাই, ঢাকায় কে কার?’

এর মধ্যে রায়হান ছুটে এলেন। বামে, দূরে একটা ফেরি দেখা যাচ্ছে। তার পিছু পিছু ছুটলাম ফেরিঘাটের দিকে। মানুষও হুড়মুড়িয়ে ছুটছে। ঘাটে পৌঁছে দেখি, ফেরিটা ছাড়বে ছাড়বে করছে। পন্টুনে দাঁড়িয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো ভিড়টাকে প্রশ্ন করি, ‘এত বিপদ নিয়েও বাড়ি যেতেই হবে? উত্তর আসে, ‘যাব না কী করব। রামপুরার কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করতাম, সেই সাইট বন্ধ করে ইঞ্জিনিয়ার চলে গেছে। অনেকেরই আর কাজ নাই হাতে। আমরা থাকতাম সাইটেই। আমি রংমিস্ত্রি, (পাশেরজনকে দেখিয়ে) ও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, এ রকম অনেকের কাজ চলে গেছে।’ যুবকটির নাম মো. জসিম, বাড়ি গোপালগঞ্জ। মো. নাজিম উদ্দিন কাজ করতেন পরিমাপযন্ত্র ওয়েটস্কেল তৈরির কারখানায়। তাঁর কণ্ঠ আরও চড়া, ‘আমরা তো গত বছর লকডাউনের সময়ও ঢাকায় ছিলাম। সরকার কি আমাদের দায়ভার নিছে? কী করব ঢাকায়, মরব একা একা? ঢাকার চেয়ে গ্রাম বেশি নিরাপদ। গ্রামে করোনা নাই।’ পারলে তখন ফেরিভর্তি সব মানুষ একযোগে বলে, ‘গ্রাম বেশি নিরাপদ।’

তাঁদের এই কথাকে সমর্থন করছে বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল। ‘পভার্টি ডায়নামিকস অ্যান্ড হাউসহোল্ড রিয়েলিটিস’ শীর্ষক এই জরিপের (প্রথম পর্ব) তথ্য বলছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এরা জনসংখ্যার সাড়ে ১৪ শতাংশ। জরিপ বলছে, শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত। গত বছর ২৭ শতাংশের মতো বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনো ফেরেনি।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমেছে আশ্চর্যজনকভাবে। সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।’

আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম জানুয়ারিতে জানিয়েছিল, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। চরম দারিদ্র্য ৪ শতাংশ বেড়েছে। কেবল কৃষকের আয় কমেনি। সেই কৃষকের সন্তানেরাই মূলত ঈদের ছুটি পেয়ে কিংবা ঢাকায় কাজ বা উপার্জন হারিয়ে এভাবে পড়িমরি করে গ্রামে ফিরছেন।

সত্যি সত্যি পড়িমরি ছুটছিল একদল মানুষ। কিন্তু ততক্ষণে ফেরি ছেড়ে দিয়েছে। কারও কারও মুখ মাস্কে ঢাকা। কেবল দেখা যায়, দীর্ঘ পথযাত্রায় ক্লান্ত ও নুয়ে থাকা শরীর, ঘর্মাক্ত কপাল, বসে যাওয়া চোখ।

ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমেছে আশ্চর্যজনকভাবে। সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি

‘ঢাকা শহরে থাকার চাইতে মরা ভালো’

দুজনের সঙ্গে কথা হলো—ওমন আলী ও মো. বেলাল। দুজনই রাজমিস্ত্রি। বাড়ি গোপালগঞ্জে। মো. বেলাল বলছিলেন, ‘ঢাকা শহরে থাকার চাইতে মরা ভালো। ঢাকায় তো চিকিৎসাও শেষ কইরা দিছে।’ ওমর আলীর মনেও খেদ, ‘চিকিৎসা যাদের আছে তাদের আছে, আমাদের জন্য নাই। এই বাইরের ভিটায় পড়ে থাকা কোনো জীবন হলো? গ্রামে যদি না খেয়েও থাকি, তবু ভালো। ওখানে আপনজনের মধ্যে মরব। আমি গ্রামে গিয়া ২০০ টাকা চায়া নিতে পারব, আপনি আমারে দিবেন? তাহলে বেকার টাইমে ব্যাচালার লাইফে ঢাকায় কী দুঃখে থাকব? জানেন না, গরিবের করোনা হয় না?’

গ্রাম কি বেশি নিরাপদ

বিভিন্ন গবেষণাতেও দেখা গেছে, করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা শহরের চেয়ে গ্রাম শক্তভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। প্রবাসী শ্রমিকের টাকা পাঠানো করোনাকালে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ২০২০ সালে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসবে ১৪ বিলিয়ন (১ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার। বাস্তবে এসেছে ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন (২ হাজার ১৭৪ কোটি) ডলার। এটা আগের বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

রবি মৌসুমে সবজির দামে মার খেলেও ধান ভালোই ফলেছে। দেশে যে খাদ্যাভাব হয়নি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে বেড়েছে, সব ওই গ্রামের কৃষক পিতা তাঁর প্রবাসী শ্রমিক পুত্র–কন্যাদের অবদান। আরও অবদান পোশাকশ্রমিকদের। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জীবন্ত জিম্মি তাঁরা। তাঁদের উপার্জনও করোনাকালে গ্রামের দরিদ্রদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা কমিয়েছে।

গ্রামযাত্রা পলায়ন নাকি প্রস্তুতি

যারা বেকার, যারা দিন এনে দিন খায়, যারা নাকি গরিব, তাদের জন্য যৌক্তিক আচরণ কোনটা? ঢাকায় বেকার বা ছুটির অবস্থায় জৈষ্ঠ্যের গরমে ঘর বা মেসের বিছানার ভাড়া গোনা নাকি গ্রামের ভিটায় আশ্রয় নেওয়া? ঈদের সময় গ্রামমুখী জনস্রোতের একটা হলো বাড়ির টান, নাড়ির টান বা পুল ফ্যাক্টর। তবে এবারের গ্রামযাত্রার পেছনে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা বা পুশ ফ্যাক্টরও বড় কারণ। যারা পালাচ্ছে, তারা জানে ঢাকায় আশ্রয় নেই, সরকারি সাহায্য নেই, রেশন নেই। অসুস্থ হলে হাসপাতালে সিট নেই, অক্সিজেনেরও অভাব। ভারতের পরিস্থিতি দেখে এই ভয় আরও বেড়েছে বলে জানালেন গোপালগঞ্জের মো. মেরাজ। তিনি ঢাকায় ছোট একটা চাকরি করেন। একাই থাকেন। বললেন, ‘টিভি দেখেন না? দিল্লিরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের এইখানে কী হইব!’

তাই হুড়মুড় করে ঢাকা ছাড়ার মধ্যে কেবল পলায়ন নেই, আছে যার যার মতো বাঁচার প্রস্তুতি।

প্যারিস টু পাটুরিয়া-মাওয়া

অনেকেই বলেন, এই দেশের মানুষ নিয়ম মানে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না। তাদের জন্য প্যারিস, লন্ডন ও কুয়ালালামপুরের তথ্য জানানো যায়। মার্চে ‘লকডাউন’ শুরু হলে প্যারিস থেকে বের হওয়ার সড়কে ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছিল।

ফেরিঘাটে বা মহাসড়কে মানুষ বিশৃঙ্খল; কারণ, সরকারি ব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খল ও অপ্রস্তুত। যদি ত্রাণ, সহায়তা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ভরসা থাকত, তাহলে মানুষ এভাবে বনপোড়া হরিণের মতো ছুটত কি না সন্দেহ। সঠিক নেতৃত্ব ও দিশা পেলে জনতাও সুশৃঙ্খল শক্তি হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা মুক্তিযুদ্ধসহ বড় বড় দুর্যোগে দেখেছি। আবার যুদ্ধ ও মহামারিতে রাজধানী যে নিরাপদ থাকে না, তা–ও মানুষের দেখা ও জানা।

‘মা, আমি ফেরি পাইছি, আইতাছি’

শুধু ঢাকা ছাড়া মানুষ নয়, গ্রামছাড়া মানুষও ছিল এই দলে। বাগেরহাটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ হারানো তিন তরুণ ফিরছেন গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এঁরা—জোবায়ের, জহিরুল ও মুরাদ। মেস বন্ধ, খাবার ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বাড়ি ফেরা ছাড়া তাঁদের আর উপায় কী?

সেই রায়হান শেষ পর্যন্ত বেলা দুইটার ফেরিটা পেয়েছিলেন। ফেরিতে উঠেই তিনি কানে ফোন তোলেন। শুনতে পেলাম, ‘মা, আমি ফেরি পাইছি, আইতাছি। তুমি চিন্তা কইরো না, সেহ্‌রির আগেই আইয়া পড়মু অনে’…নদীর বাতাস তার বাকি কথা উড়িয়ে নিয়ে গেল।

লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]