নির্দেশনাতেই আটকে মাস্কের ব্যবহার

প্রতীকী ছবি

ঘরের বাইরে মাস্কের ব্যবহার নিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনার অভাব নেই। মাস্ক না পরলে জেল-জরিমানার বিধানও রয়েছে। তারপরও সময় যত এগোচ্ছে, জনগণের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারের উদাসীনতা তত বাড়ছে। মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

সামনে শীতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মাস্ক ছাড়া এলে কাউকে সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোতে সেবা দেওয়া হবে না। গতকাল রোববার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। বেসরকারি অফিসগুলোয় এই নীতি মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে পরিদর্শন করা হবে বলেও তিনি জানান।

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মানা। আরেকটি হলো টিকা। বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনার কোনো টিকা অনুমোদন পায়নি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারির শুরু থেকে বলে আসছে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। ঘরের বাইরে মাস্ক পরা, বারবার সাবান–পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ওপরেই জোর দিচ্ছে সংস্থাটি।

গত সাড়ে সাত মাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সরকার অন্তত ৯টি নির্দেশনা দিয়েছে। গত ২১ জুলাই ১১টি ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা জারি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সেটির শুরুতেই বলা ছিল, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সেবাগ্রহীতাদের বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে হবে। সংশ্লিষ্ট অফিস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নিশ্চিতের দায়িত্বও দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং মাস্ক ব্যবহারে অনীহা আরও বেড়েছে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, শুধু জরিমানা করে লোকজনকে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করা সম্ভব নয়, এ ক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়াসহ নানা মাধ্যমে প্রচার চালানো হলেও তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

তবে সরকার মাস্ক ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে জনগণকে ঠিকমতো সম্পৃক্ত করতে পারেনি বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জনগণ মানছে না, এটি কোনো কথা নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব সরকারের। এ ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর হতে হবে, এর বিকল্প নেই।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানায় সরকার। করোনার সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাত দফায় ছুটি বাড়ায়। প্রতিটি প্রজ্ঞাপনেই বাইরে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ করা হয়। মাস্ক ব্যবহারসহ শর্ত সাপেক্ষে ৩১ মে অফিসগুলো খোলা হয়, পরে গণপরিবহন চালু হয়।

সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর থেকেই মাস্কের ব্যবহার কমতে থাকে। রাজধানীর পথেঘাটে, বাজারে, বিপণিবিতানে এখন মাস্ক পরা লোকজনের উপস্থিতি কম। আর গ্রামাঞ্চলে মাস্কের ব্যবহার নেই বললেই চলে। মাস্ক ব্যবহার না করার পেছনে লোকজন নানা যুক্তি দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, এখন দেশে করোনা আগের মতো নেই। কারও মাস্ক পরলে গরম বেশি লাগে।

গতকাল মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, শীতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে ধরে নিয়ে চারদিকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিসের বাইরে ‘মাস্ক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না’—এ রকম পোস্টার সাঁটাতে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জোহর ও মাগরিবের নামাজের সময় মাস্ক পরার বিষয়টি প্রচার করার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে বলা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন-নির্দেশনা আগেও ছিল

গত ২১ জুলাই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশনায় ১১টি ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়টি কারা কারা নিশ্চিত করবে, সেটিও বলে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বাজার ও মার্কেট কমিটি, পরিবহন মালিক সমিতিকে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত করা হয়নি।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, গণপরিবহনে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।

গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলাচলকারী ১০টি বাসের অধিকাংশ যাত্রীর মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। চালক ও চালকের সহকারীরাও মাস্ক ব্যবহারে উদাসীন।

সাভার থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী এম এম লাভলী পরিবহনের যাত্রী আফজাল হোসেন বলেন, ‘আগে নিয়মিত মাস্ক পরতাম, এখন মাঝেমধ্যে পরি। আশপাশের লোকজনও তো মাস্ক পরে না। আসলে সবার চলাফেরা দেখে তো বোঝার উপায় নেই দেশে করোনা আছে।’

হকার, শ্রমিক, রিকশা, ভ্যানচালক, হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর্মরত ব্যক্তিসহ সব পথচারীর মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। গতকাল কারওয়ান বাজার, বাসাবো, মতিঝিল, শ্যামলী, কল্যাণপুর, শাহবাগ ও গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ রিকশাচালকের মুখেই মাস্ক নেই। ফুটপাতের হকার-ক্রেতা কেউই মাস্ক পরছেন না। হাটবাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, পথচারীদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহারে উদাসীনতা দেখা গেছে।

করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত রাজধানীর মুগদা হাসপাতাল। সেখানে করোনার পরীক্ষাও হয়। গতকাল পরীক্ষা করাতে আসা সন্দেহভাজন রোগীর দুই স্বজনকে মাস্ক ছাড়াই হাসপাতালের নিচতলায় ঘুরতে দেখা যায়।

স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই

গত ৩০ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন ২০১৮ অনুযায়ী, কেউ মাস্ক না পরে বের হলে ৬ মাস জেল অথবা ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া কেউ যদি এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধা দেয় বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে তিন মাসের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

কিছু ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি না মানায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হচ্ছে। তবে রাজধানীতে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা কম। অবশ্য সচেতনতা বাড়াতে মুঠোফোনে রিং হওয়ার আগে সেবাগ্রহীতাদের মাস্ক ব্যবহার করতে সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। বারবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। জোরজবরদস্তি না করে মাস্ক পরা ছাড়া সেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলেও মাস্কের ব্যবহার অনেকটা নিশ্চিত হবে। মাঠপর্যায়ে মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসার আশঙ্কা করছে সরকার ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা। তাঁরা বলছেন, জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও তীব্র হতে পারে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মাস্ক ছাড়া সেবা না দেওয়ার উদ্যোগটি দরকারি। কিন্তু আগের প্রজ্ঞাপনগুলোর মতো কাগুজে বাঘ হিসেবে রাখলে, এটিও কাজে দেবে না। সরকার সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরলে জনগণ নিজে থেকেই মাস্ক পরত। তথ্য ঢেকে রাখার চেষ্টা করলে ভ্রান্তির মধ্যেই লোকজন আশ্বস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে নির্বাচিত ও রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমকেও সম্পৃক্ত করা জরুরি।