নিশ্চিত হয়নি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ

• ২৬টির কাজ পেয়েছে নিমিউ অ্যান্ড টিসি, শেষ হয়েছে ১৮টির।

• ২৩টির মধ্যে ৭টির চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে এইচইডি, তবে কাজ শুরু হয়নি।

• ৩০টি করার কথা ইউনিসেফ বাংলাদেশের। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

প্রতীকী ছবি
জুন মাসে ৭৯টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। ৬১টির কাজই শুরু হয়নি

দেশে করোনার সংক্রমণের সাড়ে সাত মাস পরও অধিকাংশ হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা চালু করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জুন মাসে জরুরি ভিত্তিতে ৭৯টি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে চালু হয়েছে ১৪টির, কাজ শেষে চালুর অপেক্ষায় আছে ৪টি। অথচ শীতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছে সরকার। শীতে বাকি কাজ সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, আক্রান্ত রোগীর তুলনায় হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি ছিল শুরু থেকেই। ধীরে ধীরে রোগী বাড়তে থাকলে মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তড়িঘড়ি করে অক্সিজেন ট্যাংক নেই, এমন হাসপাতালের তালিকা তৈরি করে। কিন্তু তালিকায় ভুল থাকায় আবার তা সংশোধন করা হয়। এরপর জুনের শুরুতে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ১টি প্রতিষ্ঠানকে ২৬টি হাসপাতালের কাজের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বাকি ২ প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৫৩টির মধ্যে ৭টির চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছে গত সপ্তাহে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) মো. মুহিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও চাচ্ছেন হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা দ্রুত চালু হোক। তাই যে কটির চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া গেছে, সেগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, শুধু করোনা নয়, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে অক্সিজেন-স্বল্পতা দেখা দেয় রোগীর। তাই প্রতিটি জেলা হাসপাতালে নিরবচ্ছি
ন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য জানায় সরকার। এরই মধ্যে আক্রান্ত প্রায় ৪ লাখ মানুষ। মারা গেছে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি। কোভিড-১৯ শ্বাসতন্ত্রের রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত করোনা রোগীর ক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন হতে পারে।

গত ১৪ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠানো চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ৩৯টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারকে (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেখানে গ্যাস পাইপলাইন নেই, এমন ৩০টি হাসপাতালে কোভিড তহবিল থেকে গ্যাস পাইপলাইন ও অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপন করছে ইউনিসেফ। বাকি ২৩টি হাসপাতালে এই ব্যবস্থা চালুর জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এইচইডি) নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।

তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল জুনে। কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়নি। অনুমোদন পেলে নতুন করে আবার প্রস্তুতি নিতে হবে। এতে ৩০টির কাজ শেষ করতে অন্তত ৬ মাস লাগতে পারে।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। স্থানীয়ভাবে উপজেলা পর্যায়ে কিছু হাসপাতাল নিজেরাই একটি কাঠামো গড়ে তুলেছে। ১৫-২০টি সিলিন্ডার একত্র করে পাইপলাইনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। জরুরি প্রয়োজনে এটিও সহায়ক হবে।

তিন মাসে ১৮ হাসপাতালে অক্সিজেন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জুন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ৩৯টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজের অনুমোদন পেয়েছিল নিমিউ অ্যান্ড টিসি। কিন্তু এর মধ্যে আগে থেকেই ১৩টি হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক ছিল। পরে তালিকা সংশোধন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শেষ পর্যন্ত জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে ২৬টির চূড়ান্ত অনুমোদন পায় নিমিউ।

নিমিউ অ্যান্ড টিসি বলছে, হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক বসাতে ঠিকাদার হিসেবে স্পেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডকে ১৩টি করে হাসপাতালের কাজ দেয় নিমিউ। এর মধ্যে ১৩টি হাসপাতালেরই কাজ শেষ করে অক্সিজেন সরবরাহ চালু করেছে স্পেক্ট্রা। আর লিন্ডে ৫টির কাজ শেষ করলেও চালু হয়েছে ১টি। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন পেলে বাকি ৪টির অক্সিজেন সরবরাহ শুরু হবে। আর ৮টির কাজ এখনো শুরু করতে পারেনি লিন্ডে।

এ বিষয়ে নিমিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার মোহা. আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে অক্সিজেন ট্যাংক আমদানি করছে লিন্ডে। তাই কাজ শেষ করতে দেরি হচ্ছে। ভারত থেকে ছেড়ে আসা জাহাজ শিগগিরই বন্দরে পৌঁছাবে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কাজ শেষ হয়ে যাবে।

পাঁচ মাস পর সাতটির অনুমোদন

ঢাকার বাইরে ২৩টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের কথা আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এইচইডি)। এর মধ্যে আছে ২টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৯টি ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও ১২টি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। জুনে এমন সিদ্ধান্ত হলেও চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে প্রায় ৫ মাস পার করে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অবশেষে ১৮ অক্টোবর ৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের কাজ পেয়েছে এইচইডি।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, শুধু করোনা নয়, শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে অক্সিজেন-স্বল্পতা দেখা দেয় রোগীর। তাই প্রতিটি জেলা হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

এ বিষয়ে এইচইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদন পাওয়া ৭টির কাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা হচ্ছে। বাকিগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।

অনুমোদন পায়নি ইউনিসেফ

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গঠিত কোভিড-১৯ তহবিলের টাকায় ৩০টি হাসপাতালে গ্যাস পাইপলাইন ও লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের কথা জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশের। এর মধ্যে আছে ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুরের আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আর বাকিগুলো হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালসহ বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতাল।

এ বিষয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল জুনে। কিন্তু এখনো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়নি। অনুমোদন পেলে নতুন করে আবার প্রস্তুতি নিতে হবে। এতে ৩০টির কাজ শেষ করতে অন্তত ৬ মাস লাগতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মহামারির শুরু থেকেই মারাত্মক ও জটিল রোগীদের অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষমতা হারায়। তখন বাতাস থেকে পরিমাণমতো অক্সিজেন নিয়ে রক্তে দিতে পারে না। যেসব রোগীর রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, সেই রোগীদের কৃত্রিম অক্সিজেন দিতে হয়। করোনা চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক জাতীয় নির্দেশিকাতেও অক্সিজেনের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে।

অনুমোদন পাওয়া ৭টির কাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা হচ্ছে। বাকিগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
মো. আবদুল হামিদ, এইচইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অক্সিজেন-স্বল্পতা করোনা রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে। তাই এ ক্ষেত্রে ঢিলেমি বা দীর্ঘসূত্রতার কোনো সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা একটি বড় সমস্যা, মন্ত্রণালয় ঠিকমতো কাজ করছে না। অদক্ষতা, অযোগ্যতা, সমন্বয়হীনতা ও নজরদারির বড় ঘাটতি স্বাস্থ্য খাতের নিয়মিত চিত্র। শীতের আগেই হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।