পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কবে, অজানা

আগের মাসের চেয়ে নতুন রোগী, সংক্রমণ শনাক্তের হার ও মৃত্যু কমেছে। তবে পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়।

করোনাভাইরাসের প্রতীকী ছবি

সংক্রমণের সপ্তম মাসে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী ও মৃত্যু আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের দিনে সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে। মানুষ কবে নাগাদ পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সপ্তম মাস পূর্ণ হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এখনো সংক্রমণ প্রতিরোধের কার্যকর উদ্যোগ নেই। রোগী শনাক্তে পর্যাপ্ত পরীক্ষা হচ্ছে না। অনেক সন্দেহভাজন রোগী পরীক্ষার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব রয়েছে। এসব কারণে ইতিমধ্যে দেশ একটি দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রে পড়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েক দিন ধরে রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হতে পারে।

৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানায় সরকার। সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশ দুই মাস কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও সংক্রমণ বেড়েছে। ৩১ মে থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রায় সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনজীবন এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কমলেও স্বস্তি ফেরেনি। এখনো বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান বন্ধ আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের কার্যক্রমও সীমিত। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ আছে। এর মধ্যে গতকাল বুধবার এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা হচ্ছে না বলে ঘোষণা করেছে সরকার।

মে মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। জুনে তা তীব্র আকার ধারণ করে। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমতে দেখা যায়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে নতুন রোগী শনাক্তের হার অনেকটা এক জায়গায় থমকে আছে।

সপ্তম মাসের চিত্র

সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে সংক্রমণের ষষ্ঠ মাসের তুলনায় সপ্তম মাসে নতুন রোগী কমেছে প্রায় ৪১ শতাংশ। অবশ্য এই সময় আগের মাসের চেয়ে রোগী শনাক্তের পরীক্ষাও কমেছে। আগের মাসের চেয়ে সপ্তম মাসে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ পরীক্ষা কম হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যু দুটোই কমেছে। সংক্রমণের সপ্তম মাসে (এখনো এক দিন বাকি) মোট ৮৮৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। অবশ্য এটি আগের মাসের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম। সংক্রমণের সপ্তম মাসে মোট পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এর আগের মাসে এটি ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।

সবকিছু কমলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, যে অনুপাতে নতুন রোগী কমছে, এখনো সে অনুপাতে মৃত্যু কমে আসেনি। অন্যদিকে রোগী শনাক্তের হারও এখনো অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোনো দেশে তিন সপ্তাহ রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে এখনো পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ১২ শতাংশের মতো, যা নির্দেশ করে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে বলা যাচ্ছে না। এখন দেশে পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ১২ শতাংশের মতো। এটা কম নয়। বেশ কিছুদিন ধরে এই হার দেখা যাচ্ছে। এখন যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এটা আর কমবে না, বরং সামনে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শনাক্ত ৩ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১ হাজার ৫২০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩ লাখ ৭৩ হাজার ১৫১। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত আরও ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মারা গেলেন মোট ৫ হাজার ৪৪০ জন।

শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট নিশ্চিত আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর সুস্থতার হার ৭৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা

আগামী শীতে দেশে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আসতে পারে—এমন আশঙ্কার কথা ইতিমধ্যে জানিয়েছে সরকার। তবে এখনো প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে কি না, তা নিয়েই মতবিরোধ আছে। কারণ, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি একবারও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সম্প্রতি কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও বলেছে, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ঢিলেঢালা ভাব, পাশের দেশ ভারতে সংক্রমণ বাড়তে থাকা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাড়তে থাকায় সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। এ জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারের তরফেও অবশ্য বলা হচ্ছে, প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। চীন দুই মাসের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ইউরোপের অনেক দেশেও তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সে তুলনায় এশিয়া ও আমেরিকা মহাদেশের বেশির ভাগ দেশে সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখা যাচ্ছে।

তবে ইউরোপের অনেক দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে বিশ্বের যে ১২টি দেশে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার তিনটি হলো ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও স্পেন। অথচ এই তিনটি দেশে দুই থেকে তিন মাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছিল।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়ে কম। সাধারণভাবে বলা যায়, সেখানে সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। সেখানে টেস্ট (পরীক্ষা), আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ), ট্রেসিং (রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে খোঁজা), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থাও অনেক ভালো। এরপরও সেখানে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে সংক্রমণ মোকাবিলায় এর কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনও নিশ্চিত করা যায়নি। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গা-ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে, যা সংক্রমণ আরও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। কিন্তু নিম্নমুখী প্রবণতা একটা জায়গায় এসে থেমে আছে। রোগী শনাক্তের হার এখনো ১০ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে আবার অনেকে পরীক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সব মিলে এখনো দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি বিপৎসীমার ওপরে। তিনি বলেন, শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা সরকার করছে। এ জন্য এখন থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। পরীক্ষাও বাড়াতে হবে।