পুরুষের চেয়ে নারী আরও গরিব হবেন

বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, চরম দারিদ্র্য বাড়বে। সব ক্ষেত্রেই নারীর সমতা কমবে, বৈষম্য বাড়বে।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাঁচটি বাসায় ভোর ছয়টা থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা আয় করতেন সেলিনা আক্তার। করোনা বন্ধের শুরুতেই কাজগুলো গেল। গ্রামে চলে গিয়েছিলেন, তিন বাচ্চা নিয়ে খাওয়ার কষ্টে ঢাকা ফেরেন।

কাজ জোটেনি। শেষে গত মাসে পুরোনো দুটি কাজ ফিরে পেয়েছেন। বেতন পাবেন ৬ হাজার টাকা। অর্ধেক চলে যাবে ঘরভাড়া দিতে। আগে নির্মাণশ্রমিক স্বামী মানিক মিয়ার আয় ছিল দিনে গড়ে ৫০০ টাকা। এখন তা ৪০০ টাকায় নেমেছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেনের নতুন উপাত্ত বলছে, করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারির জেরে চরম দারিদ্র্য বাড়বে। নারী দরিদ্র হবেন বেশি। কাজের সুযোগ, আয়, স্বাস্থ্য, অবৈতনিক শ্রম এবং সহিংসতা—সব দিক দিয়ে নারীর অবস্থান আরও নাজুক ও অসম হবে। সমতা যেটুকু অর্জিত হয়েছে, তা ঝুঁকিতে পড়বে।

৩০০-এর বেশি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে লাখের ওপর শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বেশির ভাগই নারী। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অনেক নারী কাজ করতেন। গৃহকর্মী, বিউটি পারলার, ক্ষুদ্র উদ্যোগের মতো নারীপ্রধান খাতগুলোতেও কাজ প্রায় বন্ধ।
নাজনীন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ ফেলো, বিআইডিএস

উপাত্তগুলো দিয়ে ইউএন উইমেন ২ সেপ্টেম্বর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম ‘ফ্রম ইনসাইটস টু অ্যাকশন, জেন্ডার ইকুয়িলিটি ইন দ্য ওয়েক অব কোভিড-১৯’। অন্তর্দৃষ্টির ভিত্তিতে বিশ্বের সরকারগুলো যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়, সেটাই লক্ষ্য।

উপাত্ত বলছে, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে ১০ কোটির কাছাকাছি মানুষ চরম দরিদ্র হবে। মাথাপিছু ১ দশমিক ৯০ ডলার বা ১৬১ টাকারও কমে দিন চালানো এই মানুষদের প্রায় অর্ধেকেই থাকবে নারী ও মেয়েশিশু। চরম দরিদ্র নারীর মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৩ কোটি ৫০ লাখ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৩০ সালের আগে পরিস্থিতি আগের মতো হবে না। আশা ছিল, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে নারীর দারিদ্র্যের হার প্রায় ৩ শতাংশ কমবে। এখন সেটা অনেক বাড়বে। ২০২১ সাল নাগাদ ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী প্রতি ১০০ পুরুষের বিপরীতে ১১৮ জন নারী চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করবেন। ২০৩০ সাল নাগাদ তাঁদের সংখ্যা ১২১-এ পৌঁছাতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর সংখ্যাটি ১২৯ হবে।

গৃহস্থালির কাজসহ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রগুলোতে নারী কর্মী বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে, গত জুন নাগাদ বিশ্বজুড়ে ৭২ শতাংশ গৃহকর্মী কাজ হারানোর কথা।

অনেক নারী করোনাকালে কাজ হারিয়ে গ্রামে গেছেন, আবার শহরে ফিরেও তেমন আয় করতে পারছেন না
নাজনীন আহমেদ ,বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ ফেলো নাজনীন আহমেদ বাংলাদেশে এসব পরিণতির আলামত দেখছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেক নারী করোনাকালে কাজ হারিয়ে গ্রামে গেছেন, আবার শহরে ফিরেও তেমন আয় করতে পারছেন না।

নাজনীন বলছেন, ৩০০-এর বেশি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে লাখের ওপর শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বেশির ভাগই নারী। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোতে অনেক নারী কাজ করতেন। গৃহকর্মী, বিউটি পারলার, ক্ষুদ্র উদ্যোগের মতো নারীপ্রধান খাতগুলোতেও কাজ প্রায় বন্ধ।

বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত একটি জরিপ গত জুলাইয়ে বলেছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে পুরুষের তুলনায় নারীর কাজ হারানোর হার বেশি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে নারীরা দ্বিগুণের বেশি হারে কাজ হারিয়েছেন।

এশিয়া ও ইউরোপের ২২টি দেশের উপাত্ত দিয়ে ইউএন উইমেনের প্রতিবেদনটি বলছে, করোনাকালে নারীর ওপর ঘরের কাজের চাপ অনেক বেড়েছে। তাঁদের ৪৯ শতাংশ ঘর পরিষ্কার করেছেন। শিশুর যত্ন আর রান্নার কাজ করেছেন ৩৭ শতাংশ করে নারী। পুরুষের ক্ষেত্রে হারগুলো ৩৩, ২৬ ও ১৬ শতাংশ।

বাংলাদেশে গত এপ্রিলে ব্র্যাকের এক জরিপ দেখেছে, কমবেশি ৯০ শতাংশ নারীর গৃহকর্ম এবং পরিবারের যত্নের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। তাঁরা বলেছেন, কোনো অবসর নেই।জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা
কাজ, নানা চাপ আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। তাঁরা বিষণ্নতায় ভুগছেন। লকডাউনে ঘরে নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে
ফেরদৌসী সুলতানা,জেন্ডার বিশেষজ্ঞ

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, কাজ, নানা চাপ আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। তাঁরা বিষণ্নতায় ভুগছেন। লকডাউনে ঘরে নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে।

ইউএন উইমেনের প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই নারীরা তাঁদের পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আয় এবং সামাজিক যোগাযোগ-সহায়তার সুযোগ কমায় এমনটা হচ্ছে। ঝুঁকিতে পড়ছে নারীর প্রজননস্বাস্থ্যও। এ সময় বিশ্বজুড়ে ৬০ শতাংশ নারী চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি। তবে প্রতিবেদনটি বলছে, বৈষম্য বাড়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কাজের সুযোগ, ন্যায্য মজুরি, পরিবার পরিকল্পনাসহ স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক আর সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলোতে দ্রুত গুছিয়ে কাজ করতে হবে। সংকটের জেন্ডার তথা লিঙ্গভিত্তিক প্রভাব সম্পর্কে উপাত্তও গোছাতে হবে।