বেদনার নীলে ছেয়ে গেছে ঈদের রাত্রি
নিশ্শব্দ জোনাক জ্বলা তিমির রাত্রি
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে এশার আজান ধ্বনিত হয়েছে আগেই
কাল ঈদ, একটু আগেই গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষিত হলো।
অন্য সময় হলে ঘরে ঘরে ফোনে ফোনে বেজে উঠত
কবি নজরুলের হৃদয়গ্রাহী গানের সেই সুমধুর সুর
ও মন রমজানেরই শেষে এলো খুশির ঈদ...
এবারের ঈদে হলো তার ব্যতিক্রম,
চারদিকে কি এক নীরবতা, আতঙ্ক, নিস্তব্ধতা।
মায়ের অপেক্ষা, ছেলে আসবে, আসবেই
কথা দিয়েছিল এবার বাবা–মার সাথেই ঈদ করবে।
পুলিশের কনস্টেবলের চাকরি, ছুটি কম,
পরপর তিনটা ঈদে বাড়ি আসেনি ছেলে
এবার অনেক আগে থেকেই সব ঠিকঠাক, ছুটিও নেওয়া হয়েছিল।
মায়ের মোবাইলে ছেলের ফোন আসেনি গত চার দিন
সেই চার দিন আগে বলেছিল, গায়ে একটু জ্বর, সাথে শুষ্ক কাশিও
কেঁপে উঠেছিল মায়ের মন অজানা আতঙ্কে
কী সব করোনার কথা বলাবলি করছে সবাই, ওটাও নাকি শুরুতে এমনি হয়।
ছেলে অভয় দিয়ে বলেছিল, কিছু ভেবো না মা, এ আর এমন কী
সব ঠিক হয়ে যাবে, সামান্য ঠান্ডা লেগেছে মাত্র।
চার দিনের অপেক্ষার প্রহর গুনেছে মা, ছেলে তার আসবেই
চট্টগ্রাম থেকে রংপুর কত দূরের পথ, রাত তো একটু হবেই।
ঈদের সরু বাঁকা একফালি চাঁদ ডুবে গেছে অনেক আগেই
তাঁরাভরা বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের মনে হয়
কত দিন দেখিনি এমন নির্মল আকাশ।
চার দিন ছেলের কোনো ফোন নেই, এ আর নতুন কী
আগেও অনেক হয়েছে এমন।
ছেলে বলছিল তার অনেক কাজ, নতুন নতুন ডিউটি
আরও কী যেন বলছিল, ছেলে নাকি ফ্রন্ট লাইনার
মা কি আর অত বোঝে? মায়ের চাই ছেলেকে, শুধুই ছেলেকে।
রাত গভীরতর হয়, দু–একটা জোনাকি পেছন বাড়ির অন্ধকার গলি থেকে
উঁকি দিয়ে জানান দিয়ে যায়, ছেলে তার আসছে।
অনেক দূর থেকে মা মা করতে সারা উঠোন তোলপাড় করে দেবে।
এশার নামাজ শেষ করে মা, জায়নামাজেই বসে থাকবে
যতক্ষণ না ছেলে এসে মা বলে ডাকবে।
মা বারবার ফোনের দিকে তাকায়, চার্জ আছে তো?
এই তো পরশু দিনই পাশের বাড়ির সোবহানকে দিয়ে নিশ্চিত হলো
ফোন তো ঠিকই আছে, তবে ছেলের ফোন আসছে না কেন?
মাঝরাত পেরিয়ে যায়, সুবহে সাদেক ছুঁই ছুঁই
ফোন আসে, জায়নামাজে একটুখানি তন্দ্রাচ্ছন্ন মা
ফোন হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে অন্য এক কণ্ঠস্বর
সালামুআলাইকুম, আমি সিএমপি কমিশনার বলছি
আপনি কি রায়হান এর মা?
জি, বলেন, কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দেন মা, কেন জানি বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
এর পরের কথাগুলো মায়ের কানে পৌঁছেছে কিনা জানা নেই।
রায়হানের ফেরা হয়নি সে রাতে, রায়হান ফিরবে না কোনো দিন
শেষ দেখা হয়নি মায়ের প্রিয় সন্তানের মুখ।
বেদনার নীলে ছেয়ে গেছে মায়ের ঈদের রাত্রি
যে রাতের আঁধার কোনো দিনও কাটবে না মায়ের জীবন থেকে।
রায়হানের মায়ের জীবনে আর কোনো দিন আসবে না কোনো ঈদ।
রায়হানের মতো এই সব অকুতোভয় সম্মুখসারির যোদ্ধাদের জন্য
রইল আমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আমরা রায়হানদের কী দিতে পারব জানি না
তবে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে একমাত্র জান্নাতই এই সব বীরদের
জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্য এবং প্রতিদান।