ভয় কমেছে, বেড়েছে উদাসীনতা

প্রতীকী ছবিরয়টার্স

দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে মানুষের মধ্যে যে ভীতি ছিল, তা অনেকটাই কমেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ভীতি কমলেও বেড়েছে উদাসীনতা। এর ফল মারাত্মক হতে পারে। কারণ, ছয় মাস পরও সংক্রমণের হার কিছুটা কমার দিকে থাকলেও মৃত্যু বড় আকারে কমার লক্ষণ নেই। এখন রোগীদের উপসর্গেও কিছু ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও বেসরকারি হাসপাতালের শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। কিছু হাসপাতাল রোগী ফিরিয়েও দিচ্ছে।
করোনার নমুনা পরীক্ষা ও করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রাজধানীর চারটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, দেশ থেকে করোনার সংক্রমণ অল্প সময়ের মধ্যে চলে যাবে না। সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে। এ জন্য নিরবচ্ছিন্ন, সমন্বিত ও স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহও দরকার।
অনেক হাসপাতালেই কোভিড-পরবর্তী সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। ঝুঁকিতে বয়স্ক রোগীরাও।

করোনা সংক্রমণের ২৩ দিনের মাথায় ১ এপ্রিল থেকে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। শুরুর দিকে নমুনা দেওয়ার জন্য হাসপাতালটিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনলাইনের মাধ্যমে সম্ভাব্য রোগীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে।
বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের থেকে করোনা নমুনা দেওয়া লোকের সংখ্যা অনেক কমেছে। আবার আগের থেকে সংগৃহীত নমুনার মধ্যে পজিটিভ হওয়ার হার কমেছে। বর্তমানে সংগৃহীত করোনার নমুনার ১২ ভাগ পজিটিভ আসছে। তবে আগে আমাদের হাসপাতালে করোনার নমুনা দেওয়ার জন্য যে ভিড় ছিল, সেই ভিড় এখন অনেক কম।’
পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও করোনার নমুনা দেওয়া লোকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গত এপ্রিল থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করে মিটফোর্ড হাসপাতাল। তখন প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ হাজির হতেন। বর্তমানে এই সংখ্যা ১০০-র নিচে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী প্রথম আলোকে বলেন, সংগৃহীত নমুনার মধ্যে পজিটিভ হওয়ার হার ১০-এর নিচে রয়েছে।
কিন্তু এই কম হার এমন ইঙ্গিত দেয় না যে করোনা দেশ থেকে দ্রুত চলে যাবে, এমনটাই মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ সহসাই দেশ থেকে চলে যাবে বলে আমার মনে হয় না। দু-একটা দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় কিন্তু সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের দেশেও সংক্রমণ অব্যাহত আছে। প্রতিদিন মৃত্যুও হচ্ছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে মৃত্যুর হার কিছুটা কম।’

ঢামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন
ফাইল ছবি

৬ সেপ্টেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা ৬৪৫। এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালে মারা গেছেন ৩৯২ জন। আর বিএসএমএমইউতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১২৫ জন।
বিএসএমএমইউর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ কিন্তু আছে। মানুষও মারা যাচ্ছে। আমাদের হাসপাতালে ২২৫টি শয্যা আছে। প্রায় সবগুলো শয্যায় করোনা রোগী আছে। ঈদুল আজহার পর হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে।’
বিএসএমএমইউর শয্যা প্রায় পূর্ণ হলেও ৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে কোভিড শয্যাসংখ্যা ১৪ হাজার ৪৭৪। এর মধ্যে রোগী ভর্তি আছে ৩ হাজার ৫৬৩ জন। খালি আছে বাকিগুলো। আর আইসিইউ শয্যার সংখ্যা সাড়ে ৫০০। এর মধ্যে রোগী আছে ৩০৭টিতে।

রায়হান রাব্বানী

রাজধানীর বেসরকারি স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউ অ্যান্ড ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট রায়হান রাব্বানী বলেন, ‘স্কয়ারে কোভিড শয্যাসংখ্যা প্রায় ১০০। গত মে মাসে যখন এখানে রোগী ভর্তি শুরু হয় তখন শয্যা প্রায় পূর্ণ হয়ে যেত। মাঝখানে কম ছিল। কোরবানির ঈদের সপ্তাহখানেক পরই শয্যার ওপর চাপ বাড়তে থাকে। দুই সপ্তাহ পর আরও বাড়তে থাকে। এখন কোনো শয্যা খালি নেই।’
বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের রেসপাইরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক রওশন আরা খানম বলেন, ‘আমাদের কাছে রোগী আসার সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে বলে মনে হয় না।’

বিএসএমএমইউর পরিচালক জুলফিকার আহমেদ আমিন
ফাইল ছবি

রায়হান রাব্বানীর পর্যবেক্ষণ, ঈদের পর যেসব রোগী তিনি পেয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগ হয় পশুর হাটে গেছেন, নয়তো ঈদের সময় ঘুরতে গেছেন।
করোনা সংক্রমণের ছয় মাসেও মৃত্যুর মিছিল থামছে না। অথচ দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী কোনো প্রকারের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। গণপরিবহনগুলোয় (বাস, লঞ্চ, ট্রেন) যাত্রীদের বেশির ভাগ মাস্ক পরেন না, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন না। ঢাকাসহ দেশের বড় শপিং মলগুলোয় ক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলোর যে নজরদারি ছিল, সেটিও এখন একেবারই অনুপস্থিত।


ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক রওশন আরা খানম বলছেন, ‘শুরুতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল প্রবল। এখন সেটা কেটে গেছে। কমেছে সজাগ থাকার মাত্রা। একটা গা ছাড়া ভাব সর্বত্র দেখছি। এটা আমাদের সবার জন্য মারাত্মক। আমাদের দেশে লক্ষণহীন রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমরা যদি সবাই উদাসীন হয়ে যাই, তবে বড় ধরনের বিপদ আসতে পারে।’
জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ দেশ থেকে কমাতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানছি না। ফলে করোনার সংক্রমণ সেভাবে কমছেও না। করোনার নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ানো দরকার।’

কোভিড-পরবর্তী সমস্যা বাড়ছে

সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বিএসএমএমইউ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কোভিড-উত্তর রোগীদের জন্য নতুন শাখা খুলেছে। বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল পোস্ট-কোভিড কেয়ার প্রোগ্রাম কর্মসূচি নিয়েছে। হাসপাতালটির চিকিৎসক রওশন আরা খানম বলছিলেন, ‘সেরে ওঠা বয়স্ক রোগীদের একটা অংশ ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছে। তাঁরা স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারছেন না। যাঁরা আইসিইউতে ছিলেন, দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি। আমরা এখন এসব রেগীর জন্য ফুসফুসের ব্যায়াম, মানসিক কাউন্সেলিং চালু করেছি। এতে উন্নতিও হচ্ছে।’
স্কয়ারের চিকিৎসক রায়হান রাব্বানীও জানান, কোভিড থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে আবার হাসপাতালে আসার ঘটনা ঘটছে। তাঁরা কোভিডে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন না বটে। কিন্তু অনেকের সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসটি অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে করোনা ভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর বাংলাদেশে রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির এক গবেষক দল এ তথ্য জানিয়েছে। গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

স্বাস্থ্যবিদ মুশতাক আহমেদ
ফাইল ছবি

চিকিৎসক রায়হান রাব্বানী বলছেন, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীরা সাত দিন পর জটিলতায় পড়তে পারেন বলে মনে করা হতো। কিন্তু অনেক রোগী সাত দিনের মধ্যেই ফুসফুসের বড় ধরনের সমস্যায় ভুগছেন।
মহামারি বিশেষজ্ঞ মুশতাক আহমেদও মনে করেন, মহল্লায় মহল্লায় করোনা সংক্রমণসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চালু করা উচিত। অর্থাৎ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় জনসাধারণকে কাজে লাগাতে হবে। আর সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

আক্রান্ত সব বয়সী, কখনো পুরো পরিবার

চিকিৎসকেরা বলছেন, করোনার ঝুঁকিতে আছে সব বয়সী মানুষ। করোনায় সংক্রমিত শিশুদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু আছে ‘শিশু করোনা ইউনিট’। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটির করোনা ইউনিটে ২৫ জন শিশু ভর্তি আছে। গত মে মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ শিশু এই ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ১০ থেকে ১২ জন শিশু মারা গেছে, যাদের শারীরিক অন্যান্য জটিল রোগ ছিল। বিশেষ করে ক্যানসার।’

ঢামেকের শিশু বিভাগের অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার
ফাইল ছবি

মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক সাঈদা আনোয়ার বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে শূন্য থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের করোনার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এসব শিশুর ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। এসব শিশুকে বাইরে নিতে হলে অবশ্যই মাস্ক পরাতে হবে। পরিবারের বয়স্কদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হলে বড়দের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’

রওশন আরা খানম

ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক রওশন আরা খানমের কথা, ‘সব বয়সী রোগী পেয়েছি। তরুণেরা অনেকে বেশি বাইরে বের হয়। তাতে সংক্রমণ বাড়ে।’
পুরো পরিবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও আছে। আর এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবারে বয়ে যায় এক প্রবল মানসিক টানাপোড়েন। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রায়হান রাব্বানী বলেন, ‘একটি পরিবারের মা-বাবা, দুই মেয়ে সবাই মিলে আমাদের হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন। এমন পরিবারের অবস্থা কী হয়, তা বলা বাহুল্য।’
স্কয়ার হাসপাতালে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর মধ্যে অন্য সময় চট্টগ্রাম ও সিলেটের রোগীরা বেশি আসেন বলে জানান ডা. রাব্বানী। এই চিকিৎসক বলেন, কোভিড রোগীদের মধ্যে কোরবানির আগে ঢাকার স্থানীয় রোগী বেশি ছিল। কিন্তু এখন রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী অঞ্চলের রোগীও বাড়ছে।