মনেও ভয়াবহ ছাপ রেখে যায় করোনা

শরীরের নানা উপসর্গের মতো মনেও ছাপ ফেলে যায় করোনোভাইরাস।
রয়টার্স প্রতীকী ছবি।

শরীরের নানা উপসর্গের মতো মনেও ছাপ ফেলে যায় করোনোভাইরাস। দুর্বলতা, জ্বর, কাশি, স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়ার মতো শারীরিক উপসর্গ তো সহজেই টের পাওয়া যায়। তবে মানসিক উপসর্গের খোঁজ পাওয়া কঠিন। সেগুলো নিজে বুঝে উঠতে, আর অন্যকে বোঝাতে বোঝাতে মানসিক জটিলতা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

উন্নত দেশগুলোয় করোনার মানসিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা চলছে। মানসিক রোগের চিকিৎসা পাওয়াও সেখানে তুলনামূলক সহজ। তবে সে তুলনায় আমাদের দেশে করোনার কারণে সৃষ্ট মানসিক জটিলতা নিয়ে গবেষণা অপ্রতুল। মানসিক চিকিৎসার সুযোগও কম। অভাব রয়েছে সচেতনতারও।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক জরিপে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে ৯০ শতাংশ দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে স্নায়বিক রোগসহ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হচ্ছে।

করোনার কারণে মানসিক জটিলতায় ভুগছেন মোজাহিদ মণ্ডল নামের একজন গণমাধ্যমকর্মী। করোনাভাইরাস প্রায় এক মাস ধরে ভুগিয়েছে তাঁকে। নিজের বাড়িতে একাই কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও তিনি সারাক্ষণই আতঙ্কে থাকেন। খাওয়ার বাটি, জামাকাপড়, বিছানার চাদর, ঘরের মেঝে বারবার মুছতে থাকেন স্যানিটাইজার দিয়ে। দিনে তাঁর আধা বোতল থেকে এক বোতল স্যানিটাইজার খরচ হয়ে যায় এভাবে। রাতে তাঁর ঘুম হয় না। বারবার সবকিছু পরিষ্কার করতে গিয়ে শারীরিকভাবে আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। এ রকম ঘটনা মোজাহিদের একার নয়; তাঁর মতো অনেকেই করোনার সংক্রমণের পর নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

এপ্রিলের শুরুতে দ্য ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর সেরে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মস্তিষ্কের নানা রোগে ভোগেন। করোনায় সংক্রমিত তিনজনের মধ্যে একজনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য বা স্নায়বিক সমস্যার লক্ষণ থেকে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠার পর সবচেয়ে বেশি ভোগেন দুশ্চিন্তায়। ১৭ শতাংশের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যায়। ১৪ শতাংশের মধ্যে দেখা যায় মেজাজের ওঠানামার সমস্যা।

করোনায় সংক্রমিত তিনজনের মধ্যে একজনের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য বা স্নায়বিক সমস্যার লক্ষণ থেকে যায়।
প্রতীকী ছবি।

ল্যানসেটের এই গবেষণার খবর পড়ে চমকে উঠেছিলেন সৌরভ (ছদ্মনাম) নামের এক যুবক। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। উপসর্গগুলো সবই সৌরভের নিজের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। খুব বেশি তীব্রতা ছিল না তাঁর। সর্দিকাশি, জ্বর, দুর্বলতা, স্বাদ-গন্ধ চলে যাওয়া—এসবে ভুগেছিলেন। ১৪ দিন পর নেগেটিভও হয়ে যান। কিন্তু মূল সংকটটা শুরু হলো এরপরে। প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙে যায় সৌরভের। ঘুম ভাঙা মাত্র মনে হয় তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বেশ কয়েকবার চিকিৎসকের কাছে গেছেন। তিনি বারবারই আশ্বস্ত করেছেন ফুসফুসে কোনো জটিলতা নেই। কিন্তু সৌরভের সমস্যা কমেনি। মাথাব্যথা, পায়ে ব্যথা, দাঁতে ব্যথা—যা–ই হোক না কেন, সৌরভ ছুটে যান চিকিৎসকের কাছে। মনে হয় এসবই করোনার প্রভাব। সৌরভ অনেকটাই বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সারাক্ষণই তিনি অসুস্থবোধ করেন। সবকিছুতেই তিনি দেখতে পান করোনার প্রভাব।

সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন শেফালী আহমেদ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়েছেন প্রায় ছয় মাস হলো। সংক্রমিত হওয়ার পর থেকেই মেজাজের ওঠানামায় ভুগছেন শেফালী। হুট করে তাঁর তীব্র রাগ হয়। অফিসের কাজে মনঃসংযোগেও সমস্যা হচ্ছে তাঁর।

‘আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় ১০০ জনের মধ্যে এক থেকে দুজন রোগী মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। এ ধরনের রোগীর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ।’
তানজির আহম্মদ, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট

শেফালী বা সৌরভরা কেউই বুঝতে পারছেন না, এসব সংকট থেকে তাঁরা কীভাবে মুক্ত হবেন। করোনার মানসিক প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা, পর্যালোচনা বা চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই দেশে। রাজধানীতে কিছুটা থাকলেও ঢাকার বাইরে সংকট আরও প্রকট।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক জরিপে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে ৯০ শতাংশ দেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে স্নায়বিক রোগসহ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে লং কোভিডে ভুগছেন—এমন রোগীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে তিনজন বলছেন, তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রয়টার্স প্রতীকী ছবি।

করোনার কারণে সৃষ্ট মানসিক জটিলতা নিয়ে ধনী ও উন্নত দেশগুলোয় লাগাতার নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। চিকিৎসাক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা করোনার কারণে দীর্ঘমেয়াদি উপসর্গ বা লং কোভিডে ভুগছেন, তাঁদের অনেকেরই রয়েছে নানা মানসিক জটিলতা। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে লং কোভিডে ভুগছেন—এমন রোগীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে তিনজন বলছেন, তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁদের স্মৃতিবিভ্রম ঘটছে। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারছেন না তাঁরা।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চ বলছে, করোনার কারণে ৮০ শতাংশ রোগীর অফিসের কাজে প্রভাব পড়ছে। তাঁরা আগের মতো মনোযোগ দিয়ে কর্মস্থলে কাজ করতে পারছেন না।

আমেরিকান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের গবেষক অভীন্দ্র নাথ বলেন, লং কোভিডে ভুগছেন—এমন তিন ধরনের রোগী রয়েছেন। প্রথমত, একদল রোগী দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতায় ভোগেন। সামান্য কাজেই তাঁরা হাঁপিয়ে ওঠেন। দ্বিতীয়ত, একদল রোগীর স্মৃতিবিভ্রম ঘটে। মনঃসংযোগ বাধাগ্রস্ত হয়। তৃতীয়ত, একদল রোগী স্নায়বিক সমস্যায় ভোগেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত জরিপ বলছে, শুধু করোনায় সংক্রমিত হলেই নয়, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ঘর থেকে অফিসের কাজ, ছুটিতে থাকা, চাকরি হারানোর কারণেও মানুষের জীবনযাত্রা, সম্পর্ক ও মনমানসিকতার ওপর প্রভাব পড়ে। এসব কারণেও অনেকে উদ্বেগে ভুগছেন। ওই গবেষণা জরিপ বলছে, এ বছরের শুরুতে প্রথম কয়েক মাসে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক হতাশায় ভুগেছেন।

কিংস কলেজ অব লন্ডনের এক জরিপে দেখা গেছে, পুরুষের তুলনায় নারীরা এ ধরনের পরিস্থিতি কিছুটা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারেন।


এদিকে দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে জানা যায়, করোনার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থ রোগীরা কীভাবে কর্মস্থলে ফিরতে পারেন, তা নিয়ে যৌথ পরিকল্পনা করেছেন নেদারল্যান্ডসের চাকরিদাতা ও চাকরিজীবীরা। লং কোভিড উপসর্গ যাঁদের রয়েছে, তাঁদের জন্য খণ্ডকালীন কাজ বা সুবিধাজনক কাজের সময় নির্ধারণের কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিছুটা সময় লাগলেও এ ধরনের রোগীরা এতে ধীরে ধীরে কর্মস্থলে ফিরতে পারবেন বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

করোনার কারণে মানসিক প্রভাব নিয়ে স্বল্পপরিসরে আমাদের দেশেও কিছু গবেষণা হয়েছে। তবে সেগুলো বেশির ভাগই পেশাভিত্তিক। এ বছরের শুরুতে চিকিৎসক ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর করোনাকালের মানসিক প্রভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ বলছে, করোনার কারণে প্রায় ২১ শতাংশ চিকিৎসক এবং ৬ শতাংশ সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী উদ্বেগে ভুগেছেন। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ চিকিৎসক ও ৭ শতাংশ সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী বিষণ্নতায় ভুগেছেন।

মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত জরিপ বলছে, শুধু করোনায় সংক্রমিত হলেই নয়, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, ঘর থেকে অফিসের কাজ, ছুটিতে থাকা, চাকরি হারানোর কারণেও মানুষের জীবনযাত্রা, সম্পর্ক ও মনমানসিকতার ওপর প্রভাব পড়ে। এসব কারণেও অনেকে উদ্বেগে ভুগছেন। ওই গবেষণা জরিপ বলছে, এ বছরের শুরুতে প্রথম কয়েক মাসে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক হতাশায় ভুগেছেন।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের অনলাইন সাময়িকী হেলিয়ন গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশে করোনা সংকট নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি বলছে, বাংলাদেশে করোনার কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ১ হাজার ৬৬ জন এই জরিপে অংশ নেন। এতে নারী অংশগ্রহণকারী ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ।

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হওয়ার পরও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন—এমন বেশ কয়েকজন রোগী তিনি পেয়েছেন। তানজির আহম্মদ বলেন, ‘আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় ১০০ জনের মধ্যে এক থেকে দুজন রোগী মানসিক সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন।’ এ ধরনের রোগীর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে তিনি মনে করেন।

মনোবিদরা বলছেন, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর রোগীকে সাহস দেওয়ার বিষয়টি খুব জরুরি। স্বজনদের অস্থির হলে চলবে না।
প্রতীকী ছবি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর সাধারণত মৃত্যুভয়, প্যানিক ডিসঅর্ডারের (আতঙ্ক ব্যাধি) মতো মানসিক জটিলতা বেশি দেখা যায়। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর রোগীকে সাহস দেওয়ার বিষয়টি খুব জরুরি। মানসিক অসুস্থতা কাটাতে শুরুতেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ও পারিবারিক বন্ধন জোরদার করার ওপর জোর দেন তিনি।

করোনার কারণে মানসিক জটিলতা নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনার বিষয়টি জানতে চাইলে তানজির আহম্মদ বলেন, ছোট পরিসরে এ ধরনের জরিপ হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কিছু গবেষণা রয়েছে। তবে এ নিয়ে বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করা প্রয়োজন।