মহামারি, মৃত্যু, বিতর্ক

করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে ব্রিটেন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের (এলএসসি) একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় তা–ই বলা হয়েছে। এতে দেখা গেছে যে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে করোনায় মৃতদের প্রায় ৫০ শতাংশের মতো ছিলেন কেয়ার হোমের বাসিন্দা। অর্থাৎ বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিক। অথচ ব্রিটেনে দুই সহস্রাধিক কেয়ার হোমে আশ্রিত বয়স্কদের মৃত্যুর সংখ্যা এ তুলনায় খুবই কম দেখানো হচ্ছে। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এটি ছিল মাত্র ২০ জন। কেয়ার হোমগুলো সামাজিক দূরত্ব রাখা দুস্কর, করোনায় বৃদ্ধদের মৃত্যুর হার বেশি এবং তাদের চিকিৎসা–সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। এলএসসির গবেষণায় তাই দাবি করা হচ্ছে, কেয়ার হোমে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।

ব্রিটেনের মতো ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও করোনায় প্রকৃত মৃত্যু কত, না নিয়ে কমবেশি প্রশ্ন আছে। ঘরে বা কেয়ার হোমে বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে করোনায় মৃত্যুর হিসাব যোগ করা হলে সংখ্যা আরও বাড়বে, এমন অভিমত আছে ইউরোপের অনেক দেশে।

মৃত্যুর হিসাব নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত দেশ অবশ্য চীন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার নয়, এখানে আসলে মৃত্যুসংখ্যা দশ গুণেরও বেশি, এমন দাবি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। মৃত্যুসংখ্যা ইচ্ছা করে কমিয়ে দেখানোর জন্য ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত আরেকটি দেশ হচ্ছে ইরান।

মৃত্যুসংখ্যা হিসেবে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোয় এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বড় ধরনের গলদ আছে, এটিও বলা হয়। তবে এটি শুধু ইচ্ছাকৃত নয়, করোনা শনাক্তকরণে মারাত্মক অসামর্থ্যকেও এ জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়।

করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা আমরা এসব বিতর্ক থেকে বুঝতে পারি। এই বিতর্কের অন্য দিকও আছে। যেমন মৃত্যুসংখ্যায় শীর্ষস্থানীয় হলেও আমেরিকায় প্রতি ১০ হাজারে মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপের অধিকাংশ উন্নত দেশের তুলনায় বেশ কম। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো প্রশংসিত হচ্ছে করোনায় মৃত্যুসংখ্যা এখনো এক অঙ্কের ঘরে রাখার সাফল্যের কারণে। লকডাউনের বিশ্বব্যাপী প্রবণতাকে উপেক্ষা করা সুইডেন সমালোচনার মুখে এটি জোরেশোরে জানিয়ে দেয় যে তাদের দেশে মৃত্যুর হার এখনো ইতালির এক-তৃতীয়াংশেরও কম।

করোনায় মৃত্যুর সংখ্যার পাশাপাশি আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। তথ্য অধিকারহীন (যেমন উত্তর কোরিয়া বা মিয়ানমার), একনায়ক (যেমন হাঙ্গেরি, কম্বোডিয়া, বেলারুশ) বা অতি সীমিত সামর্থ্যের (যেমন বুরুন্ডি) দেশগুলোয় করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এশিয়া ও আফ্রিকার আরও বহু দেশে এ সংকটগুলো আছে কমবেশি। এসব দেশে কম আক্রান্ত বা কম মৃত্যুর হিসাব তাই ভালো উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে না কোথাও। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানিতে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার হার খুব উঁচু, সেখানকার আক্রান্তের উচ্চহার বরং দেশগুলোর উন্নততর স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিচায়ক; সেটাও মানছেন অনেকে। জার্মানিতে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হারও ইওরোপের অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। শুধু স্বাস্থ্যব্যবস্থা নয়, আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বগুণও এ জন্য প্রশংসিত হচ্ছে।

করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, তথ্য অধিকার, ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামর্থ্যের পরিচায়ক হয়ে উঠছে। তবে তা বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে। এই মানদণ্ডে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ (আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা) পশ্চিমের দেশগুলোর চেয়ে বহুগুণে কম হলেও বাংলাদেশ এ জন্য প্রশংসিত হচ্ছে না। বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে থাকা দেশগুলোয় এসব সংখ্যা বরং তাদের সামর্থ্য ও সদিচ্ছার অভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। অবাধ তথ্য অধিকার দেশে (যেমন নরডিক দেশগুলো, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড) করোনা মোকাবিলায় তুলনামূলক সাফল্য দেখা হচ্ছে উন্নত রাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবে।

তবে করোনার হিসাব এখনই শেষ হচ্ছে না। বিশ্ব এখনো এ মহামারি প্রথম বা বড়জোর মধ্যপর্যায়ে আছে। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলানো দেশগুলোয় (যেমন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া) নতুন প্রবাহ আসতে পারে। করোনা দেরিতে আক্রমণ করা দেশগুলোতে সংক্রমণ বহুগুণে বেশি হতে পারে (যেমন সুইডেন)।

করোনার আরেকটি অননুমেয় সংকট হচ্ছে এর অর্থনৈতিক অভিঘাত। পৃথিবীতে মহাযুদ্ধ ও মহামারিকালে বহু মানুষ মারা গেছে খাদ্য, জীবিকা ও নিরাপত্তার মতো অন্য কারণে। করোনা–উত্তর পৃথিবী থেকে মুক্ত থাকার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্র, সুশাসন, তথ্যপ্রবাহের সংকট যেসব দেশে আছে, সেখানে অর্থনৈতিক অভিঘাতের প্রভাব হবে খুবই মারাত্মক। নতুন বিশ্বে মহামারি নিয়ে যেসব আলোচিত কল্পকাহিনি রয়েছে (যেমন মার্গারেট অ্যাটউডের দ্য ইয়ার অব দ্য ফ্ল্যাড, এমিলি ম্যানডেলের স্টেশন ইলেভেন) সেখানে অবশ্য ভয়াবহ পরিণতি দেখানো হয়েছে গোটা বিশ্বেই।

কল্পকাহিনি অবশ্য সব সময় সত্যি হয় না, এর আগে মানুষের যুদ্ধও থেমে যায় না। করোনায় আক্রান্ত আর মৃত্যুর যে হিসাবই দেওয়া হোক না কেন দেশে দেশে, এটি মোকাবিলায় এগিয়ে থাকবে উন্নত প্রতিষ্ঠান আর শাসনব্যবস্থা রয়েছে এমন রাষ্ট্রগুলো—এটি প্রায় নিশ্চিভাবে বলা যায়।

আসিফ নজরুল: লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক