মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নায়ক ফেরদৌসী কাদরী

বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী আইসিডিডিআরবির ইমিউনোলজি বিভাগের প্রধান। কলেরার টিকা নিয়ে গবেষণা ও সাশ্রয়ী দামে টিকা সহজলভ্য করে লাখো প্রাণ রক্ষা করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। ফেরদৌসী কাদরীকে নিয়ে গত মঙ্গলবার নিজের ব্লগ গেটস নোটসে লিখেছেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস।

ফেরদৌসী কাদরী

আমাদের সবার ভাবনা এখন কোভিড-১৯ মহামারিকেন্দ্রিক। তাই এই সময়টায় বিশ্বে দীর্ঘকাল ধরে চলা আরেক মহামারির কথা ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক, কলেরা। গত ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে নিরাপদ পানি এবং পয়োনিষ্কাশনের সুবিধাহীন অঞ্চলে মারাত্মক ডায়রিয়াজনিত রোগটিতে লাখো মানুষের প্রাণ গেছে। বর্তমানে চলছে কলেরার সপ্তম মহামারি। এর শুরু ১৯৬১ সালে। এর বিস্তৃতি দক্ষিণ এশিয়া থেকে আফ্রিকা ও আমেরিকা পর্যন্ত। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে কলেরা মহামারিতে ৪০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়।

এ রোগের মুখে খাওয়ার টিকাটি সাশ্রয়ী, কার্যকর ও নিরাপদ। প্রায়ই ভুলতে বসা এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ের কলেরার টিকা কর্মসূচির ব্যাপক প্রসারের কারণে ২০১৮ সালে বৈশ্বিক পর্যায়ে কলেরা সংক্রমণ ৬০ শতাংশ কমে এসেছে। অবশ্য, ২০১৯ সালে কলেরার সংক্রমণ আবার বাড়লেও মোট মৃত্যু ৩৬ শতাংশ কমেছে।

যুগান্তকারী কাজটি জীবনভর করেছেন বাংলাদেশের ইমিউনোলজিস্ট এবং সংক্রামক রোগবিষয়ক গবেষক ফেরদৌসী কাদরী। ২৫ বছর ধরে কলেরা মহামারি থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের টিকা নিয়ে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন মানুষের মধ্যে একজন তিনি।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই কলেরার বেশ কিছু টিকা পাওয়া যেত। তবে সেগুলোর দাম ছিল বেশি এবং সরবরাহ ছিল কম। বিংশ শতকের প্রথম দিকেও যে কলেরার টিকা পাওয়া যেত, তা কেবল ধনী দেশগুলোর ভ্রমণকারীরাই ব্যবহার করতেন। কিন্তু এ রোগের ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য টিকা কর্মসূচি চালানোর পক্ষে তা যথেষ্ট ছিল না।

২০১১ সালে ড. কাদরী ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তাঁর গবেষক দল নতুন ও আরও সাশ্রয়ী মুখে খাওয়ার কলেরা টিকা ‘স্যাংকল’-এর সম্ভাব্যতা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালান। ওই গবেষণার অংশীদার ছিল আমাদের ফাউন্ডেশন। গবেষণায় দেখা যায়, সাশ্রয়ী মূল্যের ওই টিকা দরিদ্র ও শহুরে পরিবেশে কলেরার বিস্তার রোধে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। টিকাটি সেখানকার মানুষকে কলেরার বিরুদ্ধে ৫০ শতাংশের বেশি সুরক্ষা দেয়।

বিশ্ব কীভাবে কলেরা মোকাবিলা করতে পারে তা নিয়ে চিন্তাভাবনায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে ড. কাদরীর গবেষণা। তিনি বলেন, ‘আপনার যদি ভালো পানি, পয়োনিষ্কাশন সুবিধা, শিক্ষা, ভালো বাসস্থান থাকে তবে কলেরা হবে না। কিন্তু এত সব ব্যবস্থা করে না ওঠা পর্যন্ত এ দুর্দশা থামানোর ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে টিকাটিই একমাত্র সমাধান।’

নিশ্চিত করে বলা যায়, দীর্ঘ মেয়াদে কলেরা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুপেয় পানি ও পয়োনিষ্কাশনের সুবিধা পাওয়া এখনো অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর উৎসস্থল ভারত থেকে বিশ্বজুড়ে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। পানি এবং পয়োনিষ্কাশন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে কলেরার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনে আমেরিকা ও ইউরোপ। স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে সুপেয় পানি এবং পয়োনিষ্কাশন সুবিধা উন্নত করার কাজ এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু অবকাঠামো উন্নত করার কাজ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। অন্যদিকে কলেরার টিকা কর্মসূচি তাৎক্ষণিকভাবে জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে।

বিল গেটস

কলেরার প্রকোপ ঠেকাতে ২০১৩ সালে টিকা মজুত করতে সাহায্য করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরপর থেকে বিশ্বে ৬ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে। স্যাংকল ছাড়াও আরেকটি সাশ্রয়ী মূল্যের কলেরা টিকা ইউভিকোল এখন পাওয়া যায়। ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা গ্যাভি টিকাদানে বেশি সংক্রমণ হওয়া দেশগুলোকে সহযোগিতা করছে। তবে প্রতিরোধমূলক এ পদ্ধতি সামনের বছরগুলোতে আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো কলেরা ছড়ানোর আদর্শ পরিবেশ তৈরি করতে পারে।

তবু অগ্রগতি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। ঘনবসতির শিবিরে থাকা এসব রোহিঙ্গা নিয়ে কলেরার মহামারির উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। তবে সরকারের সঙ্গে একত্রে ড. কাদরী যে টিকাদান কর্মসূচি চালান, তাতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দূর করতে সাহায্য করেছে। কাদরী বলেন, ‘টিকাদান কর্মসূচি না চালালে সেখানে পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে পারত। আমরা বিশাল একটি মহামারি ঠেকানোর পাশাপাশি মৃত্যু রোধ করতে পেরেছি।’

এ ধরনের সাফল্য কলেরা প্রতিরোধের লড়াইয়ে নতুন আশা জোগাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কলেরা নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক টাস্কফোর্সে ৫০টি প্রতিষ্ঠান একত্রে কাজ করছে। টাস্কফোর্সের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কলেরায় মৃত্যু ৯০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং ২০টি দেশ থেকে কলেরা সম্পূর্ণ নির্মূল করা।

ড. কাদরীর অগ্রণী কাজের কল্যাণে বিশ্ব এখন এ লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে এবং একদিন এমন হতে পারে, যখন কলেরার মতো রোগ সত্যিই ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে।

(ঈষৎ সংক্ষেপিত)