মা, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার রক্তকরবী বৃক্ষ

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

করোনায় এত মানুষের প্রাণহানির পরও আশার আলো জাগছে দেশে দেশে। বৈশ্বিক এই মহামারি সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে ইউরোপের দেশে দেশে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড অন্যতম। ইতালিতে সংক্রমণের হার কিছুটা কমে এসেছে। কিছু দোকানপাট খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্পেনে লকডাউন কিছুটা শিথিল হচ্ছে। খুলে দেওয়া হয়েছে কনস্ট্রাকশন–জাতীয় কাজ। তবে সব রকম সেফটি বজায় রেখে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারবে। অন্যদিকে ডেনমার্কে প্রাইমারি স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। সুইডেন লকডাউন আগে থেকে শিথিল ছিল। অস্ট্রিয়ায় দোকানপাট লকডাউনের আওতামুক্ত করা হয়েছে। মৃত্যের সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে। আশার আলো ফুটে উঠেছে দেশে দেশে। করোনার আতঙ্কে বদলে যাওয়া দৃশ্যপট কিছুটা স্বাভাবিক হতে চলেছে।
এমনি একটা দিন ১০ এপ্রিল, ইউকে সময় রাত ৯.৩০ মিনিটে খবর পেলাম, মা না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। কখনো আর ফিরে আসবে না। অপ্রত্যাশিত এ দুঃসংবাদ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। মায়ের মৃত্যু প্রত্যেক সন্তানের কাছে অত্যন্ত বেদনার। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। অবশ্য কয়েক দিন থেকে মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। বয়ঃসন্ধিকালে যা হয়। বয়সের ভারে নুইয়ে যাওয়া শরীরে শয্যাগত ছিল বহুদিন। মনের ভেতর অস্বস্তি ছিল সব সময়। কখন কি হয়। অসম্ভব এক মাতম আমার চারপাশে। নিজেকে এক মুহূর্ত ধরে রাখতে পারছিলাম না। অপ্রত্যাশিত কান্নার স্বর বেরিয়ে আসছে মুখ দিয়ে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। কখনো এমন হয়নি। কখনো ভাবিনি মা এভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। জীবিত মাকে কখনো এমনভাবে অনুভব করা হয়নি। অদৃশ্য মায়ের প্রতিচ্ছবি সত্যিই শোকাবহ। মায়ের অপূর্ণতা উপলব্ধি করছি তীব্রভাবে মনেপ্রাণে। যা প্রকাশ করা যায় না। এভাবে কত সময় অতিবাহিত হলো জানি না। যখন বুঝতে পারলাম, আমি একটা চেয়ারে বসা, আমার দুই হাঁটুতে মাথা রেখে আমার ছেলেমেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
জীবন বহমান নদীর মতো, কখনো থেমে থাকে না। বয়ে চলে আপন গন্তব্যে। সময়ের পরিক্রমায় আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসব একদিন। ব্যস্ত হয়ে যাব আপন বাস্তবতায়। সংসার, ছেলেমেয়ে, কাজ। সময়ের কাঁটা সব সময় নির্ভুল। তবু মা। মাকে ঘিরে দুনিয়ার সব স্মৃতি। স্বপ্নসুখের না–বলা কত কথা। যত আবেদন, অনুভূতি, আবদার। মায়ের কোনো আবদার নেই। ভালো–মন্দের কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। সন্তানের পরিপূর্ণতা তাঁদের একমাত্র চাওয়া–পাওয়া। সন্তানের জ্বর হলে মায়ের অস্থিরতা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। মা সন্তানের সম্পর্ক চির শাশ্বত চির নিবিড়। মায়ের তুলনা শুধু মা। চোখ বন্ধ করলেই মায়ের ছবি ভেসে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
যত বার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। মা শুধু একটি কথা বলত, কখন আসবি?
সব সময় একটা মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া হতো। আসব।
তবে কখন কোন সময় কোন দিন কিছুই বলা হতো না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বে বাস্তবতার কারণে অনেক সময় যাওয়া হতো না। সত্যি বলতে কি, প্রত্যেক প্রবাসীর এমনই হয়।
দু–এক দিন ফোনে কথা না হলে, মা ফোন করত অতি সহজে। প্রথম কথা, কত দিন ফোন করিসনি?
কদিন আগে তো কথা হলো।
না, সেই তো অনেক আগে।
কী খেয়েছিস?
ব্রেকফার্স্ট লাঞ্চ ডিনার।
সন্তানের প্রতি মায়ের অকৃপণ ভালোবাসা দূরে থাকলে বেশি উপলব্ধি করা যায়।
গত বছর এপ্রিলের প্রথম দিকে আমরা মাকে দেখতে যাই। মা বিছানায় শয্যাশায়ী। শরীরের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। নিজে নিজে উঠা বসা, খাওয়া কিছুই করতে পারে না। তবে মায়ের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। মা বিছনায় শুয়ে শুয়ে তদারকি করছে রান্নায় কী কী করা হয়েছে। নাশতার আইটেম কি। থাকার বিছানা ঠিক করা হয়েছে কি না। মায়ের এ রকম খুশি কখনো দেখিনি।
মনে হয়, এই সেদিনের কথা, আমরা পাঁচ ভাই তিন বোনের একান্নবর্তী পরিবার। আমরা প্রাইমারি সেকেন্ডারি স্কুল–কলেজপড়ুয়া। বাবা সকাল–সন্ধ্যা অফিস। মা পুরাদম গৃহিণী। ঘরভরা মানুষের গমগম। আত্মীয়স্বজন সব সময় লেগে থাকত। বলতে গেলে গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছ। সব সময় একটা উৎসব উৎসব ভাব। অপূর্ণতা বলতে কিছুই ছিল না। কী চমৎকার ছিল সেই দিনগুলো। এসবের পেছনে মায়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন বদলেছে, প্রয়োজনের তাগিদে আমরা দেশ–বিদেশে ভিন্ন ভৌগোলিক স্থানে আমাদের বসবাস।
যেদিন শেষবারের মতো চলে আসব, কী বার ছিল মনে নেই। আকাশে রোধের খেলা। অপূর্ব সবুজের সমাহার চারদিকে। কি যে ভালো লাগছে। মা জননী জম্মভূমি। মাকে বললাম, আমরা যাচ্ছি। মা বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। গলার স্বর ধরে এসেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আমার ছেলেমেয়ে শেষবারের মতো মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করেছে। নিজে অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। হু হু করে কেঁদে উঠলাম। মায়ের শেষ কথা ছিল, কখন আসবি আবার? এই যেন শেষ দেখা। এই যেন শেষবিদায়। এই যেন মা নামক একটা জীবনগল্পের যবনিকা।
সদ্য পরলোকগত মায়ের জন্য একটা বিষণ্ণতা সব সময় তাড়া করে। হোম কোরান্টিনের কারণে এই বিষণ্নতা তীব্রতা হয়। কখনো মন খারাপ হলে কাচের জানালার ফাঁক দিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেঘ আসে মেঘ যায়। তারই মাঝে সূর্য উঁকি দেয়। মা নেই ভাবতেই চোখে জল আসে। মা, তোমাকে মিস করছি অনেক।