রোগী ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে

করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

করোনায় আক্রান্ত বাবা কার্তিক বর্মণের শয্যাপাশে ছেলে দীপু বর্মণ। নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ৮৪ বছর বয়সী কার্তিক বর্মণ ১২ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এখানেই চিকিৎসাধীন তাঁর আরেক ছেলে টিটো বর্মণ। গতকাল দুপুরে
ছবি: আশরাফুল আলম

করোনা সংক্রমণ আবারও খারাপের দিকে যাচ্ছে। নতুন শনাক্ত রোগী, শনাক্তের হার ও মৃত্যু—তিন সূচকই বাড়তির দিকে। মহামারি পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে নতুন করে ভয় দেখা যাচ্ছে।

সর্বশেষ এক দিনে ১৮ হাজার ৬৯৫ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৭৭৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ১০ শতাংশ। গত তিন মাসের মধ্যে এত সংক্রমণ হয়নি। শুধু সংক্রমণ নয়, মৃত্যুও বেড়েছে। গতকাল সোমবার ২৬ জনের মৃত্যুর খবর জেনেছে দেশের মানুষ, যা গত আড়াই মাসের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।

গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রমণের এসব নতুন তথ্য গণমাধ্যমে পাঠায়। গণমাধ্যমে সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরপরই রাস্তাঘাটে- অফিসে, দোকানে এ নিয়ে মানুষ কথা বলতে শুরু করেন। সরকার লকডাউন দেবে কি না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কি না, এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাস্ক পরার ব্যাপারে কড়াকড়ি করতে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবেন।

তবে কেন সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে, তার সুস্পষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারছেন না। গতকাল দুজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন রোগতত্ত্ববিদ, একজন অণুজীববিজ্ঞানী ও একজন পরামর্শকের সঙ্গে বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য কারও কাছে নেই।

বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কাজ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা এবং টিকা দেওয়ার মধ্যে সরকারি কাজ সীমিত হয়ে আছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দেশব্যাপী প্রচার নেই।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ১৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পাঠানো এক চিঠিতে সব মানুষের মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার গত কয়েক মাসের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্রমণের হার রোধের জন্য সর্বক্ষেত্রে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার একজন সিভিল সার্জন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের তিনটি বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত হাসপাতালগুলোকে আবার কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে, মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে প্রচার চালাতে এবং প্রয়োজনে মাস্ক পরায় বাধ্য করার ব্যাপারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে বলা হয়েছে।’

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে

তিন সপ্তাহ আগে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা, নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার এবং মৃত্যু কম ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে এগুলো বাড়ছে। এর কারণ কী?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় রোগতত্ত্ববিদ প্রথম আলোকে বলেন সম্ভাব্য কারণ দুটি। প্রথমত, যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনাভাইরাসের রূপান্তরিত নতুন ধরন বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে ৫ জানুয়ারি। এ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে কি না, সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়। দ্বিতীয়ত, মৌসুমি আবহাওয়ার প্রভাবও থাকতে পারে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির একটি বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন দ্রুত হওয়া দরকার।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, অন্তত ১০ জনের নমুনা পরীক্ষায় যুক্তরাজ্যে পাওয়া ভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন শনাক্ত হয়েছে।

আইইডিসিআর বলছে, যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের মধ্যে এ ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়। তাঁদের ঢাকা ও সিলেটে শনাক্ত করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থার কথা বলা হলেও সবাই তা মানছেন না বলে অভিযোগ আছে।

অণুজীববিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, রূপান্তরিত ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে লুকোচুরি করতে দেখা গেছে। তবে রূপান্তরিত ভাইরাসের উপস্থিতির চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করার প্রবণতা বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।

করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে করণীয় নির্ধারণে হিমশিম খেয়েছেন নীতিনির্ধারকেরা। বিজ্ঞানীরাও অনেক বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে কতটা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে, তার তথ্যও নেই। সুতরাং সংক্রমণের বর্তমান প্রকোপ কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে, তা কেউ অনুমান করতে পারছেন না।

তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মানুষের বেপরোয়া আচরণকে দায়ী করেছেন করোনাবিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে গুরুত্ব হারিয়েছে।’

একই ধরনের কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল দেখা যাচ্ছে। বিয়েশাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এসব জায়গায় মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এগুলো সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ।’ তাঁরা বলেছেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।

এ পর্যন্ত ৪৪ লাখের কিছু বেশি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন। এ সংখ্যা সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয়। জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, জনসমাগম থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেছেন, ‘মাস্ক না পরে ঘরের বাইরে এলে প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’