শীতের শুরুতেই হাসপাতালে ভিড়

  • নয়টি সরকারি হাসপাতালে ৮৬ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি।

  • নয়টি বেসরকারি হাসপাতালে ৬৪ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি।

ঢাকায় সাধারণ শয্যা

  • সরকারি হাসপাতালগুলোর ৭৫% শয্যায় রোগী ভর্তি আছে।

কয়েক দিন ধরে শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদ থাকায় করোনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন মিরপুরের বাসিন্দা এক নারী। নমুনা দেওয়া শেষে স্বামী তাঁকে মাস্ক পরিয়ে দিচ্ছেন। গতকাল সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ঢাকায় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শয্যা জোগাড় করতে রোগীর স্বজনদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালগুলোর প্রায় সব আইসিইউ শয্যাই ভর্তি। সাধারণ শয্যাগুলোতেও রোগী বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার ৯টি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১১৩টি। গতকাল মঙ্গলবার ৯৭টি শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল। ফাঁকা ছিল ১৭টি শয্যা, অর্থাৎ ৮৬ শতাংশের বেশি আইসিইউতে রোগী ভর্তি ছিল।

করোনার জন্য নির্ধারিত চারটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে জটিল করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় অনেক রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।

করোনার জন্য নির্ধারিত যে হাসপাতালগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আবার চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা বাড়াতে সরকার চেষ্টা করছে। যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই আইসিইউর ব্যবস্থা করা হচ্ছে
হাবিবুর রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (এমআইএস)

শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে আসছে সরকার। এরই মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনা শনাক্ত রোগীর হার ঊর্ধ্বমুখী। গত ১৬ নভেম্বর থেকে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দৈনিক ২ হাজারের ওপরে থাকছে। একই সঙ্গে মৃত্যুও বাড়ছে।

শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড-১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্তদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জটিল প্রায় সব রোগীর আইসিইউ শয্যার পাশাপাশি ভেন্টিলেটর দরকার হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (এমআইএস) হাবিবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনার জন্য নির্ধারিত যে হাসপাতালগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আবার চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা বাড়াতে সরকার চেষ্টা করছে। যেখানে সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই আইসিইউর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের জন্য হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের কোনো আইসিইউ শয্যাই গতকাল ফাঁকা ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। এ ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫টি শয্যার ১১টিতে, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬টি শয্যার ১০টিতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি আইসিইউ শয্যার ১৪টিতেই রোগী ভর্তি ছিল।

সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম। কোনো হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা নেই। বাধ্য হয়ে মাকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে
মেহেদী হাসান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউর বিভাগীয় প্রধান শাহজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতালের ১০টি আইসিইউতে সব সময় রোগী ভর্তি থাকছে। একটা শয্যার জন্য একাধিক রোগী অপেক্ষায় থাকছে। ঢাকার বাইরে থেকে করোনার জটিল রোগীদের ঢাকায় পাঠানোর কারণে আইসিইউগুলোতে রোগীর চাপ বেশি। আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় অনেক জটিল রোগীকে অন্য হাসপাতালেও পাঠাতে হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসানের মা রহমত আরা এখন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন। মেহেদী বলেন, ‘সরকারি কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম। কোনো হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা নেই। বাধ্য হয়ে মাকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে।’

অবশ্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত আইসিইউ শয্যা ফাঁকা থাকছে কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় করোনা রোগীদের জন্য নয়টি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে ২০৩টি। এর মধ্যে গতকাল রোগী ভর্তি ছিল ১২৯টি শয্যায়। অবশ্য তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল ৪৩টি। এই হাসপাতাল বাদে অন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই বললেই চলে।

রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ সুবিধাসহ ৪২ শয্যার করোনা ইউনিট রয়েছে। গতকাল এই হাসপাতালের আইসিইউ এবং সাধারণ কোনো শয্যা ফাঁকা ছিল না। হাসপাতালের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আল ইমরান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ সময় সব শয্যাতে রোগী থাকছে। বিশেষ করে আইসিইউ ফাঁকা থাকছেই না।

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে জটিল করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আইসিইউ শয্যা জোগাড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সাধারণ শয্যাতেও রোগী বাড়ছে

করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ঢাকার নয়টি সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যাতেও ভর্তি রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একসময় সাধারণ শয্যার ৭০ শতাংশের বেশি শয্যা ফাঁকা থাকত। অথচ গতকাল ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর ৭৫ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২ হাজার ৩৯৭টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৯১টি শয্যায় গতকাল রোগী ভর্তি ছিল। করোনার জন্য নির্ধারিত নয়টি ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেই সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি বেড়েছে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে করোনার জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ২৭৫টি। গতকাল এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিল ৩৫২ জন। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার চেয়েও ৭৭ জন রোগী বেশি ভর্তি ছিল এই হাসপাতালে। এর আগে গত সোমবার ধারণক্ষমতার চেয়ে ৬৬ জন বেশি রোগী ভর্তি ছিল।

আইসিইউ শয্যা ফাঁকা থাকছে না, সাধারণ শয্যাতেও রোগী ভর্তি থাকছে। দেশে আবার করোনা রোগী বাড়তে শুরু করেছে, এটি তারই ইঙ্গিত। এত দিনেও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সম্ভব হয়নি, এটি দুঃখজনক। সরকার করোনার জন্য নির্ধারিত যেসব হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলো আবার দ্রুত চালু করতে হবে
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য

ঢাকার বাইরে রোগীর চাপ কম

করোনার চিকিৎসার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর বাদে সারা দেশে এখন সাধারণ শয্যা আছে ৭ হাজার ১৬৪টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব হাসপাতালে গতকাল ভর্তি ছিলেন ৫৫৬ জন। খালি ছিল ৬ হাজার ৬০৮টি শয্যা। অর্থাৎ ৯২ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে ছিল। আবার নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে ২১৯টি। গতকাল আইসিইউতে ছিলেন ৮৩ জন। অর্থাৎ আইসিইউর ৬২ শতাংশ শয্যা ফাঁকা ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ২২৫ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ২২৪ জন আর মারা গেছেন ৬ হাজার ৬৭৫ জন। চিকিৎসাধীন রোগী আছেন ৭৭ হাজার ৩২৬ জন।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ শয্যা ফাঁকা থাকছে না, সাধারণ শয্যাতেও রোগী ভর্তি থাকছে। দেশে আবার করোনা রোগী বাড়তে শুরু করেছে, এটি তারই ইঙ্গিত। এত দিনেও আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সম্ভব হয়নি, এটি দুঃখজনক। সরকার করোনার জন্য নির্ধারিত যেসব হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছিল, সেগুলো আবার দ্রুত চালু করতে হবে।