সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি যাঁদের, সেই যৌনকর্মীরা টিকায় পিছিয়ে

করোনা শনাক্ত
প্রতীকী ছবি

নারায়ণগঞ্জ নগরের টার্মিনাল এলাকায় কাজ করেন ভাসমান যৌনকর্মী আসিফা (২৮-ছদ্মনাম।)। তিনি ছয় বছর ধরে এ পেশায় আছেন। করোনাকালে সরকারের টিকা কার্যক্রম চললেও এখন পর্যন্ত টিকা পাননি। অক্ষয় নারী সংঘ নামে ভাসমান যৌনকর্মীদের একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে আছেন আসিফা। এই সংগঠনের মাধ্যমেই টিকা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।  

আসিফা বলছিলেন, ‘পরিচয় নাই, কোনো কাগজ নাই। তাই কেউ টিকা দিতে চায় না। কিন্তু কিছু একটা ব্যবস্থা কেউ কইর‌্যা টিকা দেওনের ব্যবস্থা করলে বাঁইচ্যা যাইতাম।’

অক্ষয় নারী সংঘের অধীনে আছে সাড়ে ৩০০ যৌনকর্মী। সংগঠনটির সভাপতি কাজল আখতার জানান, কর্মীদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই টিকা হয়নি। তাঁদের বেশির ভাগেরই ভোটার আইডি কার্ড ও জন্মনিবন্ধন কোনোটিই নেই। সিভিল সার্জন অফিসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, অন্যদের টিকা দেওয়া শেষ হলে তাঁদেরও দেওয়া হবে।
কাজল আখতার বলেন, ‘মেয়েগুলো ঠিকানাহীন, পরিচয়হীন। তাই এই দুরবস্থা। কিন্তু ওরা অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসে। আমার তো মনে হয়, সমাজে খুব ঝুঁকিপূর্ণ তো ওরাই। কিন্তু অসহায় বলেই হয়তো ওদের দিকে কারও নজর নেই।’  

বাংলাদেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা এক লাখ দুই হাজারের মতো। এ তথ্য জানান দেশের যৌনকর্মীদের সংগঠনগুলোর জোট সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি আলেয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘দেশের মোট যৌনকর্মীর মধ্যে ১০টি যৌনপল্লিতে চার হাজার কর্মী থাকে। বাকি সব ভাসমান। এই যৌনকর্মীদের অন্তত ৯০ শতাংশই এখনো টিকা নিতে পারেননি। অনেক যৌনপল্লিতেও জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের অভাবে যৌনকর্মীরা টিকা পায়নি।’

যেসব পল্লিতে বেশির ভাগ যৌনকর্মীরা এখনো টিকা পাননি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ শহরের কান্দিরপাড় যৌনপল্লি। এ পল্লিতে মোট যৌনকর্মীর সংখ্যা সাড়ে তিন শ। তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে বলে জেলার সিভিল সার্জন নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘সেখানে কতজন আছেন, তা তো জানি না। আমাদের কাছে ৮৫ জনের তালিকা দেওয়া হয়েছিল, আমরা তাঁদের টিকা দিয়ে দিয়েছি।’

দেশের ১০টি যৌনপল্লিতে এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংগঠন লাইট হাউস। করোনাকালে যৌনকর্মীদের নানা ধরনের সহায়তার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতে সহায়তা করেছে সংগঠনটি। লাইট হাউসের হিসাব তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মো. হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ময়মনসিংহে ৩০ শতাংশের কম এবং টাঙ্গাইলে ৪০ শতাংশের মতো যৌনকর্মী টিকা পেয়েছেন। ফরিদপুরের রথখোলা যৌনপল্লির ৩০ জন এবং যশোরের ২৫ জন যৌনকর্মী টিকা পাননি। আর ভাসমান যৌনকর্মীদের মধ্যে টিকা না পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। তাঁরা ১ হাজার ৭০০ ভাসমান যৌনকর্মীকে পরিচয়পত্র তৈরিতে সহায়তা করেছেন।

দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায়। এখানে ১ হাজার ২০০–এর মতো যৌনকর্মী থাকেন। এলাকাটি পড়েছে গোয়ালন্দ উপজেলার মধ্যে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় এক হাজার কর্মীকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাকিদের আগামী সপ্তাহে দেওয়া হবে।

দৌলতদিয়ার যেসব যৌনকর্মীকে এখনো টিকা দেওয়া হয়নি, তাঁদের মূল সমস্যা হলো জাতীয় পরিচয়পত্রের অভাব। তাঁদের একজন নিশা (২৮)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএনও অফিস থেকে কথা দিয়েছে, কাগজ তৈরি করে টিকা দেবে। তাই অপেক্ষায় আছি।’

দেশের ১০ যৌনপল্লির সাড়ে চার হাজার কর্মীর বাইরে যে প্রায় এক লাখ ভাসমান যৌনকর্মী আছে, তাদের টিকা দেওয়াটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন লাইট হাউসের প্রধান নির্বাহী হারুনুর রশীদ।

দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। এই সময় বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া গেলে সংক্রমণ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি কমে যেত। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেলায় এ কথা আরও বেশি করে খাটে। পেশাগত কারণেই যৌনকর্মীরা তাঁদের কাছে আসা পুরুষদের সবচেয়ে কাছে যান। তাই তাঁদের ঝুঁকি অনেক বেশি বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনায় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা আছে। তাই এসব গোষ্ঠীর মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনার গণটিকাদান শুরু করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত দেশের ৪৪ শতাংশ মানুষ এক ডোজ এবং ৩১ শতাংশ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ করোনার টিকা পেয়েছেন। মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায় সরকার। শুরুর দিকে দেশে পর্যাপ্ত টিকা আসা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর এ দুই মাসে সেই অনিশ্চয়তা অনেকটাই দূর হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ২২ কোটি ২ লাখ ৩৭ হাজার। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ মিলে ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭২ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৮ কোটি ৮৬ লাখ ডোজের বেশি টিকা মজুত আছে। আগামী মার্চের মধ্যে আরও ৯-১০ কোটি টিকা আসার সম্ভাবনার কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে পর্যাপ্ত টিকাও আছে। কিন্তু তারা দ্রুত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারছে না। সর্বশেষ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কেন্দ্র ব্যবহার করেও টিকাদানে গতি বাড়াতে পারেনি তারা। যৌনকর্মীদের মধ্যে টিকাদানের গতিও বাড়েনি। আবার তা শুধু যৌনপল্লিতেই সীমাবদ্ধ। ভাসমান যৌনকর্মীদের বেশির ভাগই যে টিকার আওতার বাইরে আছেন, তা স্বীকার করেন কোভিড-১৯ টিকা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যসচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা কর্মসূচির পরিচালক ডা. শামসুল হক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভাসমান যৌনকর্মীদের টিকার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তাঁরা একটি মুঠোফোন নম্বর নিয়ে গেলে সব জায়গা থেকেই টিকা পেতে পারেন।’

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের মুঠোফোন থাকলেও কেন্দ্রে গিয়ে টিকা পাননি। যৌনকর্মীদের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ কর্মসূচি দরকার বলে মনে করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাংসদ আরমা দত্ত। তাঁর পরামর্শ হলো, যৌনকর্মীদের টিকাদান দ্রুত করতে যৌনকর্মী সংগঠনগুলোর সহায়তা নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের এ কাজে নিয়োজিত করতে হবে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি বলেই জানান সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি আলেয়া আক্তার।

যৌনকর্মীদের টিকা দানের বিষয়টি সরকারের প্রাধান্যের তালিকায় যে পেছনে আছে, তা স্পষ্ট হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা কর্মসূচির পরিচালক ডা. শামসুল হকের কথাতেও। তিনি বলেন, ‘টিকাদানে সরকারের লক্ষ্য আমরা পূরণ করতে পারি নাই। এটার কাছাকাছি চলে এসেছি। এরপরই আমরা বাসশ্রমিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনব। এর মধ্যে ভাসমান যৌনকর্মীরাও পড়বেন। তবে বিষয়টি আমাদের নজরে এনে ভালো করেছেন।’