সময়মতো ভারতের টিকা আসছে না

ভারত থেকে চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো করোনার টিকা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। জোর কূটনৈতিক তৎপরতার পরও ভারত থেকে টিকা পাওয়ার বিষয়টি শিগগিরই সুরাহা হচ্ছে না। এর ফলে যাঁরা ইতিমধ্যে টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, সময়মতো তাঁদের দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার ব্যাপারে বিকল্প উৎসকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ভারতের ওপর অতিনির্ভরশীলতার কারণে এ অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে গতকাল বুধবার পর্যন্ত টিকা মজুত ছিল ২৭ লাখ ২২ হাজারের কিছু বেশি। এখন প্রতিদিন দেড় থেকে দুই লাখ টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ হারে টিকা দেওয়া চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ে টিকা ফুরিয়ে যাবে। শিগগির টিকার নতুন চালান না এলে প্রথম ডোজ পাওয়া অনেকেই টিকা পাবেন না। এ ছাড়া ইতিমধ্যে নিবন্ধন করেছেন, এমন অনেক মানুষকে টিকার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ৩ কোটি ডোজের মধ্যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭০ লাখ টিকা দিয়েছে বাংলাদেশকে। প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও এরপর বাংলাদেশে আর কোনো টিকার চালান আসেনি। এ বিষয়ে গত রোববার বাংলাদেশে টিকা সরবরাহকারী বেক্সিমকো ফার্মা চিঠি দিয়ে সরকারকে বলেছে, সরকার যেন টিকার জন্য ভারত সরকারকে সর্বাত্মকভাবে অনুরোধ করে।

গতকাল ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে জানা গেছে, চুক্তির আওতায় সেরাম থেকে বাকি ২ কোটি ৩০ লাখ টিকা পেতে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারতে এখন করোনা সংক্রমণের যে পরিস্থিতি, তাতে আগামী এক–দেড় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী কতটা টিকা পাবে তা অনিশ্চিত।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে চুক্তি অনুযায়ী বাকি টিকা পেতে আমরা যোগাযোগ করছি। তা ছাড়া চীন ও রাশিয়া থেকে বাণিজ্যিক চুক্তি কিংবা যৌথ উৎপাদনের আওতায় টিকা সংগ্রহের চেষ্টাও চলছে। রাশিয়া ও চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস এ নিয়ে ওই দেশের সরকার এবং সেখানকার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি জানান, শুধু রাশিয়া ও চীন নয়, অন্য দেশ থেকেও টিকা পেতে সরকার যোগাযোগ করছে।

সংকটে এসে সবাই স্বার্থপর হয়ে যায়। তারপরও দুই দেশের সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা আমরা দাবি করি, সে দিক থেকে দেখলে এ ধরনের পরিস্থিতি না হলেই ভালো হতো।
মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, বাংলাদেশ শুরু থেকে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল থেকেছে। বিকল্প হিসেবে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকার কথা ভাবার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশ এ দুটি বিকল্পের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়েরম্যান মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে বিজ্ঞানকে ছাপিয়ে কূটনীতি ও অর্থনীতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের পথে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলাম। সরকার পরামর্শ নেয়নি। পরামর্শ নিলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’
জুলাইয়ের আগে সেরামের উৎপাদন বাড়ছে না

ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারত সরকার তাদের দেশের ২৫ কোটি নাগরিককে জুলাইয়ের মধ্যে দুই ডোজ করে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে চায়। এ জন্য ভারতের অন্তত ৫০ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ভারতের কাছে ১২ কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা ছিল। তাদের আরও ৩৭ কোটি ৩০ লাখ ডোজ লাগবে। এখন পর্যন্ত সেরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেকের যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের যে সামর্থ্য, তা দিয়ে সেই লক্ষ্য দ্রুত পূরণ করা কঠিন।

এদিকে সেরাম মে মাসের শেষে টিকার উৎপাদন বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, তা–ও সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, সেরাম জুলাই মাসের শেষে টিকার মাসিক উৎপাদন ছয়-সাত কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটিতে নিতে পারবে।

মূলত কাঁচামালের সংকটে পড়ায় সেরাম কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র টিকার কাঁচামালের রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপাকে পড়েছে। গত শুক্রবার সেরামের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা এক টুইটে কাঁচামালের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।


এ পরিস্থিতিতে ভারতের টিকাবিষয়ক জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি রাশিয়ার টিকা স্পুতনিকের জরুরি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। স্পুতনিকের টিকা পেতে ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চুক্তিও করেছে। ভারত জরুরি ভিত্তিতে মর্ডানা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং ফাইজারের টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

চুক্তির টিকা চায় বাংলাদেশ

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সরকারের উচ্চপর্যায়ে ভারত থেকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় টিকার বাকি চালান বুঝে পাওয়ার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে।


বাংলাদেশ যে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী টিকা পেতে চায়, বিষয়টি উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ ‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসার সময় উপহার হিসেবে ১২ লাখ টিকা বাংলাদেশকে দিয়েছেন। এ টিকা নিয়ে বাংলাদেশের তেমন আগ্রহ ছিল না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তখন বলা হয়েছিল, এখন চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত বাকি টিকা বুঝিয়ে দেওয়া হোক।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারতে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ার কারণে টিকা রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলের চাপ আছে। সামগ্রিকভাবে ভারতে টিকার বিষয়টি দেখভাল করছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি।

সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার বিষয়ে ভারতের কোনো উদ্যোগ আছে কি না, জানতে চাইলে গতকাল ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুয়ায়ী টিকাপ্রাপ্তির সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে গতকাল ই–মেইলে ও মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। এর আগে গত মঙ্গলবার বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের মতো টিকা আনার চেষ্টা করছি। সরকারও চেষ্টা করলে ভালো হয়।’


কূটনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক অনেক গভীর। দুই দেশের নিবিড় বন্ধুত্বের সময়ে এসে চুক্তি করে, আগাম টাকা দিয়ে টিকার সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যায়। এতে করে জনমনে সম্পর্ক নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হচ্ছে, যা সম্পর্কের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংকটে এসে সবাই স্বার্থপর হয়ে যায়। তারপরও দুই দেশের সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা আমরা দাবি করি, সে দিক থেকে দেখলে এ ধরনের পরিস্থিতি না হলেই ভালো হতো। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজের বদলে ২৫ লাখ ডোজ দিয়ে যদি বলা হতো বাকিটা দ্রুত দিয়ে দিচ্ছি, তাহলেও ভরসা পাওয়া যেত। কিন্তু একেবারেই বন্ধ রাখাটি ঠিক হলো না।’