সরকারের সব সংস্থাকে যুক্ত করার পরামর্শ

দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির ১৩ দফা সুপারিশ। সুপারিশ বাস্তবায়নে সাংগঠনিক কাঠামো দরকার।

বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণের উদ্যোগ নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, করোনা মোকাবিলায় গোটা সরকারব্যবস্থাকে যুক্ত হওয়া দরকার। করোনার শীতকালীন প্রকোপ ও দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে বাস্তবায়নযোগ্য ১৩ দফা কর্মপরিকল্পনায় বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গত বুধবার অধিদপ্তরে এ কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে। পরদিন বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পরিকল্পনায় মূলত করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস এবং সব ধরনের কাজে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

সুপারিশগুলো আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব, সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুতই বাস্তবায়ন করা হবে
অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক

চার পৃষ্ঠার এ কর্মপরিকল্পনার শুরুতে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত করা, বিচ্ছিন্ন করা (আইসোলেশন), সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং) এবং সঙ্গনিরোধসহ (কোয়ারেন্টিন) মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে স্বপ্রণোদিতভাবে জনগণের বা কমিউনিটির সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজন খুব বেশি। এ কর্মপরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১৩টি কাজের সুপারিশ দিয়েছি। পাশাপাশি কাজগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে এবং কারা তা বাস্তবায়ন করবেন, তা–ও বলে দিয়েছি। আমরা মনে করি, সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’

সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ প্রায় দুই মাস ধরে বলে আসছেন যে করোনার প্রকোপ শীতকালে বাড়তে পারে বা দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার আশঙ্কা আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নির্ধারণে ১৯ নভেম্বর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই সভায় পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিকে (ওয়ার্কিং গ্রুপ) বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে আছেন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন, আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব দেওয়ান মো. হুমায়ুন কবির এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই কর্মসূচির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক পূরবী মতিন।

১৩ দফা কর্মপরিকল্পনার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপারিশগুলো আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব, সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুতই বাস্তবায়ন করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, করোনা মোকাবিলায় এনজিওগুলোকে আরও কার্যকরভাবে কী করে যুক্ত করা যায়, তা নিয়েও এ কমিটি কাজ করছে।

করোনা মোকাবিলায় ১৩ দফা সুপারিশ

  • করোনা মোকাবিলা জাতীয় পরিকল্পনার মূল্যায়ন ও সংশোধন।

  • কমিউনিটি ক্লিনিককে সম্পৃক্ত করতে হবে।

  • শহরে মনোযোগ বাড়ানো দরকার।

  • চাই অর্থ বরাদ্দ।

  • গোটা সরকারব্যবস্থার সম্পৃক্ততা।

  • উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কমিটিগুলো সক্রিয় করতে হবে।

  • এনজিওগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।

  • দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন সেন্টার খুলতে হবে।

  • জনসচেতনতা বাড়াতে চাই বড় উদ্যোগ।

  • তারকা ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করতে হবে।

  • বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ করতে হবে।

  • প্রসার হবে সফল উদ্যোগের।

  • কেন্দ্র ও মাঠে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থাকতে হবে।

বাস্তবায়নযোগ্য পরামর্শ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এপ্রিল মাসে করোনা মোকাবিলার কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছিল। তা সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছিল আগস্ট মাসে। শুরুতে বিশেষজ্ঞ কমিটি বলেছে, ওই কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করে সংশোধন ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে হবে। সংশোধিত কর্মপরিকল্পনায় বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয় গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।

কমিটির সদস্যরা সুনির্দিষ্ট কাজের সুপারিশের পাশাপাশি সেই কাজের প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়নে কারা যুক্ত থাকবে, তারও উল্লেখ করেছে। সর্বজনীন মাস্ক ব্যবহারের জন্য মাস্ক উৎপাদন, বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে মাস্ক বিতরণের কথা বলেছে কমিটি। দরিদ্র মানুষ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্সচালকদের বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে মাস্ক বিতরণ করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখতে বলা হয়েছে। এ কাজে বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ওষুধ কোম্পানি ও ব্যাংককে যুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে। বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণের কাজটি জেলা প্রশাসককে সমন্বয় করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারির শুরু থেকে বলে আসছে, করোনা মোকাবিলা শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। এ কাজে গোটা সরকারব্যবস্থাকে যুক্ত হতে হবে। একই কথা বলেছে কমিটি। তারা বলেছে, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোকে মহামারি মোকাবিলার কাজে যুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারির প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছে কমিটি।

সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সঠিক নেতৃত্ব দরকার। তা না হলে এগুলো বিচ্ছিন্ন পরামর্শ হয়েই থাকবে, বিশাল সমস্যা সমাধানে কাজে আসবে না।
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

সংক্রমণ বেশি এমন জেলা ও উপজেলার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সহায়তামূলক আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র খোলার কথা বলেছে কমিটি। কমিটি বলেছে, এসব কেন্দ্র খোলা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। কাজটি করতে হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা দিতে হবে, সেই নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।

কমিটি মনে করে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে কার্যকরভাবে করোনা মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনকে এ কাজে যুক্ত করার কথা তারা বলেছে। শহরের বেশি নজরদারির কথা বললেও গ্রামপর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশনকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে।

কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে করোনা মোকাবিলার সফল উদ্যোগ (বেস্ট প্র্যাকটিস) খুঁজতে বলেছেন। কমিটির সদস্যরা বলেছেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় সারা দেশের সেরা কাজগুলো খুঁজে বের করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠসেবা ইউনিট কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।

করোনা–সংক্রান্ত বার্তা মানুষের কাছে আরও কার্যকরভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ক্রিকেটার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগানোর কথা বলেছে কমিটি। কমিটি মনে করে, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলা সম্ভব। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে কমিউনিটি রেডিও, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বিলবোর্ড, লিফলেট ও পোস্টারকে কাজে লাগাতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, গণতন্ত্র ও সুশাসন, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন খাতে যুক্ত এনজিওগুলোকে কাজে লাগানোর কথা বলেছে কমিটি। এ কাজে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুপারিশগুলোর বেশ কিছু কাজ আগেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল, কিন্তু করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও সঠিক নেতৃত্ব দরকার। তা না হলে এগুলো বিচ্ছিন্ন পরামর্শ হয়েই থাকবে, বিশাল সমস্যা সমাধানে কাজে আসবে না।’