সাহস নিয়ে তাঁরা রোগীর পাশে

করোনায় যখন স্বজনেরাও রোগীর কাছ থেকে দূরে থাকতেন, তখন নার্সরা সেবা দিয়েছেন। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব নিয়েছেন।

করোনা মহামারির এই সময়ে সাহস নিয়ে রোগীর পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নার্সরা। করোনার টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন দুই নার্স। গতকাল রাজধানীর তেজগাঁওয়ে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটে
ছবি: দীপু মালাকার

দেশে গত বছর যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হয়, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের আইসিউ ইনচার্জ নার্স শামসুন্নাহার কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁকে করোনা ইউনিটে দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানান। মাঝে কয়েক মাসের বিরতি বাদে সেই থেকে তিনি করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছেন।

যখন সবাই করোনা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন, তখন কেন স্বেচ্ছায় করোনা ইউনিটে গেলেন, জানতে চাইলে মধ্যবয়সী শামসুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুঃসময়ে যদি মানুষের পাশে না থাকি, তবে এই পেশায় কেন আছি।’

করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকেরা যেমন রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে গেছেন, তেমনি রোগীর পাশে থেকেছেন নার্সরা। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস জানিয়েছে, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ৫৯টি দেশের ২ হাজার ৭১০ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) হিসাবে, দেশে ১৪ হাজারের বেশি নার্স সরাসরি করোনা রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে তিন হাজারের বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন ২৫ জন। এই হিসাবটি শুধু সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের।

# করোনায় মারা গেছেন ২৫ জন নার্স।
# আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজারের মতো।
# শুরুর দিকে করোনা ওয়ার্ডে কাজ করা কেউ কেউ হয়েছিলেন হেনস্তার শিকার।

আজ বুধবার (১২ মে) পালিত হবে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘নার্স: এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য খাতে একটি দর্শন’। নার্স দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ১২ মে দিনটি বেছে নেওয়ার কারণ, এদিন আধুনিক নার্সিং সেবার সূচনাকারী ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জন্মদিন। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস ১৯৬৫ সাল থেকে তাঁর স্মরণে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস হিসেবে পালন করছে। বিএনএ জানায়, বাংলাদশেও ১৯৭৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

নার্সিং পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে সারা বিশ্বেই নার্সদের ভূমিকা নতুন করে সামনে এসেছে। বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য খাতে নার্সরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, তা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

নার্সরা বলেছেন, করোনার শুরুর দিকে হাসপাতালে নানা রকম সংকট ছিল। করোনা রোগীর সেবার কারণে সামাজিকভাবে তাঁদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। কেউ কেউ হেনস্তারও শিকার হয়েছেন। তবু তাঁরা পিছু হটেননি। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন সব ভয়কে উড়িয়ে।

বিএসএমএমইউর নার্স শামসুন্নাহার স্বেচ্ছায় করোনা ইউনিটে কাজ নেওয়ার পর কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তুলে ধরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ আমাদের দেখলে মনে করত, আমরাই করোনার জীবাণু ছড়াচ্ছি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্ব পালনকারী নার্সদের একজন চন্দনা রানী হালদার। তিনি যে ওয়ার্ডে কাজ করেন, সেখানে গতকাল ৬০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এ ওয়ার্ডে সকালের পালায় ছয়জন এবং বিকেলে ও রাতে তিনজন করে নার্স দায়িত্ব পালন করেন। চন্দনা বলেন, ‘সব রোগীকে সমানভাবে সেবা দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও এত কম জনবলে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সমস্যা আছে, তবু আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

চন্দনা রানী করোনার মধ্যেই গত বছর ঢাকা মেডিকেলে নিয়োগ পান। শুরু থেকেই দায়িত্ব করোনা ওয়ার্ডে। তিনি বলেন, ‘চারদিকের পরিস্থিতি দেখে মনে কিছুটা ভয় ছিল। তবু সাহস নিয়ে কাজ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখনো তরুণ। এটাই মানুষের জন্য কাজ করার সেরা সময়।’

করোনায় আক্রান্ত হয়ে নার্সদের মধ্যে প্রথম মারা যান সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্স (ব্রাদার) রুহুল আমিন (৪৮), গত বছরের জুনে। তাঁর অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া একটি ছেলে আছে। রুহুল আমিনের স্ত্রী শাহীন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময়েও তিনি (রুহুল আমিন) নিয়মিত কাজ করে গেছেন।

রুহুল আমিনের পরিবার ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছে। নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, মারা যাওয়া ২৫ জন নার্সের মধ্যে ১৮ জন ৩৭ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। বাকিদের ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়াধীন।

বিএনএর হিসাবে দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রায় ৩৮ হাজার নার্স কাজ করেন। বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। সংগঠনটির দাবি, হাসপাতালের শয্যার অনুপাত বিবেচনা করলে দেশে আরও ৮০ হাজার নার্স প্রয়োজন।

বিএনএ সভাপতি ও সেবা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইসমত আরা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নার্স নিয়োগ দিচ্ছে। তবে আরও প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথম দিকে নার্সরা সুরক্ষাসামগ্রী দেরিতে পান। এত কিছুর পরও নার্সরা সেবা থেকে পিছু হটেননি। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে দোষত্রুটি সব পেশাতেই থাকে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট তেরেজা বাড়ৈ করোনাকালে সকালে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন শেষে বিকেলে একটি আইসোলেশন সেন্টারে সেবা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘করোনার শুরুর দিকে স্বজনও রোগীর কাছে যেতে ভয় পেত। তখন রোগীর সব দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপর। ভয় না পেয়ে আমরা সেবা দিয়ে গেছি।’ তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক।