সেই গল্পের কথা মনে হয়

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডা. দিলীপ কুমার নাথ ক্লাসে একটা গল্প বলেছিলেন। একবার এক মনীষী মা ছেলের মাতৃভক্তিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, ‘হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে বাদশাহর চেয়েও উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করুন।’ কয়েক বছর পরে কুষ্ঠের মহামারি শুরু হলো। কুষ্ঠরোগীদের দ্বীপান্তরের নির্দেশ দিলেন বাদশাহ। কিন্তু ওদের সেবা করতে কেউ দ্বীপে যেতে চাইল না। এগিয়ে এল সেই ছেলেটি। সানন্দে সে চলে গেল সেই কুষ্ঠ–অধ্যুষিত দ্বীপে। রোগীদের সেবা করতে করতে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে সে–ও মারা গেল একসময়। দ্বীপবাসীরা তাঁকে উচ্চতম মর্যাদায় অভিষিক্ত করল।

ক্লাসে সে গল্প শুনে মনে মনে খানিকটা হেসেছিলাম। ভেবেছিলাম, এভাবে সেবা দিতে দিতে মরে গিয়ে বড়ও হওয়া যায়!

৩০ এপ্রিল ২০২০। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩৯ বিসিএস থেকে দুই হাজার চিকিৎসককে একযোগে নিয়োগ দিলেন এই মহামারির কারণে। আমি আমার সাড়ে তিন বছরের মেয়ে শারলিজ আর তার বাবাকে নিয়ে চলে এলাম প্রথম পোস্টিং পাবনা জেলায়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একদিন করোনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েই গেল।

শুরুর দিকেই এখানে বাইপাস সড়কের পাশে বিস্তীর্ণ খোলা ধানি জমির মাঝখানে বেশ খানিকটা জায়গার ওপর তৈরি নতুন হাসপাতালটিকে ‘কোভিড ডেডিকেটেড’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। হাসপাতালটি মূল শহর থেকে দূরে। আমিসহ তিনজন চিকিৎসক সাত দিন টানা ডিউটি এবং সঙ্গে ১৪ দিনের আইসোলেশনের উদ্দেশে বাড়িঘর ছেড়ে গিয়ে উঠলাম সেই হাসপাতালে।

মেয়েটির জন্য প্রায়ই মন খারাপ লাগতে শুরু করল। সে বুঝি এখনই আহ্লাদী স্বরে বলে উঠবে, ‘মা, আমাকে একটু আদর করবে, প্লিইইই...জ!’ ওকে ছেড়ে এত সময় আগে কখনো তো থাকিনি। কী যে দুশ্চিন্তা হয়!

যাহোক, সেই যাত্রার শেষ নাইট ডিউটি করছি। নিচে পাহারায় নিবিষ্ট কয়েকজন পুলিশ সদস্য আর চারপাশের ছমছমে পরিবেশ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন বেশ কয়েকজন করোনা রোগী।

মধ্যরাতের খানিক বাদে ষাটোর্ধ্ব বাবাকে নিয়ে এক যুবক এলেন পাশের উপজেলা থেকে। বাবার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬৫ শতাংশ। অক্সিজেন ছাড়া আমার হাতে বিশেষ কোনো অস্ত্রও নেই। হাই ফ্লো অক্সিজেনও তাঁর স্যাচুরেশন বাড়াতে পারছে না। ভীতসন্ত্রস্ত ছেলেকে বললাম দ্রুত আইসিইউ সুবিধা–সংবলিত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, সকাল হলেই নিয়ে যাব।’

সে রাতে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহও অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় কিছু নম্বরে ফোন দিয়ে সাড়া না পেয়ে পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে রাত পেরোনোর অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার মা–বাবা দুজনই ডাক্তার। তাঁরা ডাক্তার হওয়ায় ঈদ, আম–কাঁঠালের ছুটি, রাতের ঘুম—এসব যে বিশেষ বড় কিছু নয়, তা বুঝে গিয়েছি সেই কবে।

ভোরবেলা যখন বুঝতে পারলাম অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা যায়নি, তখন তো মাথা খারাপ অবস্থা। অ্যাম্বুলেন্স পেতে কম করে হলেও চার–পাঁচ ঘণ্টা খরচ হয়ে গেছে। সকাল ৯টায় যখন বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নির্ধারিত হাসপাতালে পাঠানো গেল, ততক্ষণে আমার রক্তে অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা নিচে নেমে এসেছে। ডিউটি না থাকা সত্ত্বেও সহকর্মী ডা. সানজানা আপু সে রাতে দারুণ সহযোগিতা করেছেন আমাকে।

কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাওয়া কোনো কোনো মানুষ পরে ফোন করে জানান, তিনি ভালো আছেন এবং সারা জীবন আমাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন। তখন সব হতাশা, বিষাদ, দুশ্চিন্তা আর পরিবারের সবাইকে দূরে রেখে দিনের পর দিন হাসপাতালে কাটানোর বেদনা মুছে যায়। অপার আনন্দে মন ভরে যায়।

আবার স্যারের ক্লাসে বলা সেই গল্পের কথা মনে হয়। ভাবি, মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর পরও একজন হয়ে উঠতে পারেন সম্রাট। আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই চিকিৎসকদের স্মরণ করছি, যাঁরা এ যুদ্ধে সেবার পথ বেছে নিয়ে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। নিশ্চয় তাঁদের জন্মদাত্রী মায়েরা তাঁদের শ্রেষ্ঠতম আসনে দেখতে চেয়েছিলেন। আজ তাঁরা তা–ই পেয়েছেন।