৫০ লাখ টিকা আসছে আজ

  • ৬৪ জেলায় টিকা পৌঁছাবে বেক্সিমকো।

  • সরকারি ওষুধ পরীক্ষাগার থেকে টিকার ছাড়পত্র নেওয়া হবে।

  • বেশি টিকা এলে সংরক্ষণের জায়গা কম।

  • অবশেষে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি।

  • অ্যান্টিবডি পরীক্ষার প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হয়নি।

টিকা
ছবি : রয়টার্স

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা ৫০ লাখ করোনার টিকা আজ ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। বিমানবন্দর থেকে এই টিকা বেক্সিমকোর টঙ্গীর গুদামে নেওয়া হবে। সারা দেশে পাঠানোর আগে এই টিকা সরকারি ওষুধ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে ছাড়পত্র নেওয়া হবে।

চার দিন আগে ভারতের উপহার হিসেবে ২০ লাখ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। আর সেরাম থেকে ছয় মাসে তিন কোটি টিকা কেনার চুক্তি আছে। অন্য দিকে কোভ্যাক্স থেকে দেশের ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বাইরে আরও টিকা কেনার পরিকল্পনা আছে সরকারের। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রতি মাসে ৫০ লাখের বেশি টিকা এলে তা রাখার মতো জায়গা তাদের নেই। বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা এলে বাড়তি জায়গার প্রয়োজন হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল রোববার দুপুরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আজ সোমবার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৫০ লাখ টিকা ঢাকায় আসবে। এর আগে ২১ জানুয়ারি ভারত সরকারের উপহার হিসেবে ২০ লাখ টিকা এসেছে। এই ৭০ লাখ টিকা রাখা ও বিতরণের সব প্রস্তুতি সরকার নিয়ে রেখেছে।

টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

আসছে ৫০ লাখ টিকা

সরকার, সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এই টিকা কেনা হচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত এই টিকা কোভিশিল্ড নামে উৎপাদন করছে সেরাম। দেশে এই টিকা সরবরাহ করবে বেক্সিমকো। বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এই টিকা উড়োজাহাজে করে ঢাকায় পৌঁছাবে। বিমানবন্দরে বেক্সিমকোর গাড়ি থাকবে। বিমানন্দর থেকে টিকা নেওয়া হবে বেক্সিমকোর টঙ্গীর নতুন সংরক্ষণাগারে। এরপর সরকারের চাহিদা অনুযায়ী এই টিকা ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেক্সিমকোর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিটি ব্যাচের টিকা সরকারের ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানো হবে। এই টিকা ভারতের পুনে থেকে আসবে দিল্লি বিমানবন্দরে, সেখান থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে যাবে টঙ্গী। এই সময়ে তাপমাত্রার কোনো হেরফের হয় কি না, হেরফের হলে তার প্রভাব টিকার ওপর পড়বে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য টিকা পরীক্ষা করোনা হবে।

বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে তিন কোটি টিকা সরবরাহের বাইরে বেক্সিমকো আরও ১০ লাখ টিকা আনবে। এই টিকা মূলত ওষুধশিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের দেওয়ার জন্য আনা হচ্ছে। তবে এই টিকা খোলা বাজারে বিক্রি করা হবে না।

সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তা

বেশি টিকা এলে তা কোথায় রাখা হবে, তা নিয়ে চিন্তায় আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, এক মাস বিরতিতে যদি ৫০ লাখ করে টিকা আসে, তা হলে সেই টিকা সংরক্ষণের জন্য জায়গা আছে। অতিরিক্ত জায়গার দরকার হবে না। সমস্যা হবে যদি বেশি টিকা আসে।

বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে দেশের ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা দেওয়ার কথা। সেই টিকা কবে আসবে, তা নিশ্চিত কেউ বলতে পারছে না। তবে কোভ্যাক্স বলেছে, এ বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে তারা কিছু টিকা পাঠাবে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা এলে তা সংরক্ষণের জন্য ৬৭ দশমিক ১৪ ঘনমিটার কোল্ড স্পেস বা সমপরিমাণ ফ্রিজার স্পেসের প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে জেলার জন্য অতিরিক্ত ১৭৯টি আইএলআর (আইস লাইনার রেফ্রিজারেটর) এবং ৩১২টি ডিপ ফ্রিজ কিনতে হবে। আর উপজেলার জন্য ২৯৪টি আইএলআর ও ২৯৪টি ডিপ ফ্রিজ কিনতে হবে।

এদিকে সরকার কোভ্যাক্সের কাছে থেকে আট লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলে তা নষ্ট হবে। স্থায়ী কমিটিকে দেওয়া প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশে মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের টিকা দেশে এলে তা কার্টন থেকে বের করে ৩ থেকে ৫ দিন মাইনাস ১৫ থেকে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। অতি দ্রুত তা মানুষকে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবহনের কথা বিবেচনায় রেখে এই টিকা সিটি করপোরেশন এলাকায় দেওয়া যুক্তিসংগত হবে।

তৈরি হচ্ছে হাসপাতাল

রাজধানীর পাঁচটি হাসপাতালে আগামী বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এর আগের দিন একটি হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান শুরু হওয়ার কথা আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন বলে একাধিক কর্মকর্তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন।

গতকাল বেলা দেড়টায় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে করোনার টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। একাধিক কর্মীকে দেয়াল ও সিঁড়িতে রং করতে দেখা যায়। বহির্বিভাগের খোলা জায়গায় অনেক চেয়ার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ওয়ার্ড মাস্টার সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার এখানে টিকাদান উদ্বোধন হবে। গত শনিবার স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান বলেছিলেন, এই হাসপাতালে একজন নার্সকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে করোনার টিকাদান কর্মকাণ্ড শুরু হবে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায়।

টিকা দেওয়া হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ জানুয়ারি ১০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। কারা টিকা নেবেন, সেই তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। একই ধরনের প্রস্তুতির কথা বলেছে ঢাকা মেডিকেল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও টিকা দেওয়া হবে।

অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি

সরকার অবশেষে করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এখন থেকে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যাবে।

কোনো কোনো রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে, মূলত এটাই অ্যান্টিবডি। শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে সাধারণত আবার সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন করোনায় আক্রান্ত শরীরে কত দিন অ্যান্টিবডি থাকবে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা কয়েক মাস ধরেই অ্যান্টিবডি পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার কথা বলে আসছেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব কে আক্রান্ত হয়েছেন, কে হননি। একমাত্র গবেষণার কাজে এই পরীক্ষার অনুমতি ছিল। এখন অন্য কাজেও তা ব্যবহার করা যাবে।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, কার অ্যান্টিবডি আছে কার নেই, তা বিবেচনা করে করোনার টিকা দেওয়া হবে না। টিকা সবাইকেই দেওয়া হবে।

তবে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা যাবে, তা স্পষ্ট করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের জানা নেই। জেনে জানাতে হবে।’