ধর্ষণের পর বিয়ে, এরপর নির্যাতন করে তালাকের হুমকি

ধর্ষণপ্রতীকী ছবি

মানুষের জীবন থেকেই কাহিনি-চলচ্চিত্রের সৃষ্টি হলেও কিছু জীবনের গল্প বিস্মিত করে। মনে প্রশ্ন জাগে, এক জীবনে এত কিছু কেন ঘটে? এমনই এক জীবন বয়ে চলেছেন ২৩ বছরের এক তরুণী। শৈশব থেকেই বিরূপ পরিবেশের মুখোমুখি মেয়েটির জীবনে ঘটে গেছে একের পর এক বেদনাদায়ক ঘটনা। এর মধ্যেই তিনি প্রতারণা ও ধর্ষণের শিকার, ধর্ষণের পর গর্ভধারণ ও গর্ভপাত, ধর্ষকের সঙ্গে সংসারের আশ্বাসে সম্পর্ক চালিয়ে নেওয়া, সন্তান জন্মদান, ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে এবং এখনো তাঁর নানা ধরনের হুমকি-ধমকি সয়ে চলেছেন বলে জানিয়েছেন।

সম্প্রতি দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রথম আলোর কাছে নিজের জীবনের ঘটনাগুলো তুলে ধরেন ওই তরুণী। কথা বলতে গিয়ে বারবার কাঁদছিলেন তিনি। জানান, তাঁরা দুই বোন খুব ছোট থাকতেই মা স্বামীর সংসার থেকে চলে আসতে বাধ্য হন। পরে মায়ের বিয়ে হলে সেই সংসারে জন্ম নেয় এক প্রতিবন্ধী ভাই। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীও চলে যান। একা সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন মা। তখন তাঁদের দুই বোনকে প্রথমে কুমিল্লা ও পরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে অবস্থিত সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা) রেখে যান তিনি।

এক যুগ আগে বড় বোনের বয়স ১৮ বছর হলে শিশু পরিবার থেকে তাঁকে সেলাই মেশিন দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন বোন ছাড়া একা বিষণ্ন লাগত। পরে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়ে আর ফেরেননি। মেয়েটির ভাষায়, সেটাই হয়তো তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।

ওই তরুণী যাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন, তিনি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের কার্যসহকারী আকতার ফারুক। সংস্থার কল্যাণপুর শাখায় তিনি চাকরি করেন। তিনি সংস্থাটির কর্মচারীদের একটি অংশের ট্রেড ইউনিয়ন সিবিএর (কালেকটিভ বারগেইনিং এজেন্ট বা যৌথ দর-কষাকষি প্রতিনিধি) যুগ্ম সম্পাদক। আর কয়েক মাস পর তিনি অবসরে যাবেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে আকতার ফারুক ও বিচার চেয়ে মেয়েটি যাঁদের কাছে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলো প্রতিবেদক।

মাজারে গান গাইতে গিয়ে পরিচয়

ওই তরুণী শিশু পরিবারে থাকাকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে পুরস্কার পেতেন। শিশু পরিবার ছেড়ে গ্রামে ফেরার পর বাড়িতে চরম অনটন থাকলেও মা-ভাই-বোনের সঙ্গে থাকতে ভালো লাগত তাঁর। মেয়েটির ভাষায়, অভাব এমন ছিল যে বাড়িতে খাবারও থাকত না। ওই সময় কেউ একজন তাঁর মাকে বলেন, মেয়ের গানের গলা ভালো। মাজারে গিয়ে গান গাইলে কিছু রোজগার হবে। মা প্রথমে তাঁকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ এবং পরে ঢাকার মিরপুরের মাজারে আসেন। মাজারে আসা লোকজন গান শুনে টাকা দিতেন। তিন বছর তিনি মাজারে মাজারে গান গেয়েছেন। এ সময়েই তাঁর বড় বোনের বিয়ে হয়। এটা ভগ্নিপতির দ্বিতীয় বিয়ে। ঢাকার শনির আখড়ায় বড় বোনকে আলাদা ভাড়া করা বাসায় রাখতেন তাঁর স্বামী। ঢাকায় এলে বোনের এ বাসাতেই মেয়েটি ও তাঁর মা থাকতেন। বছর পাঁচেক আগে মিরপুর মাজারে আকতার ফারুকের সঙ্গে পরিচয় হয় ওই তরুণীর। এরপর ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরলে ফারুক মুঠোফোনে নিয়মিত কল করতেন তাঁকে। ফারুক বিবাহিত। তাঁর আরেকটি সংসার রয়েছে।

ধর্ষণ ও গর্ভপাতের অভিযোগ

ওই তরুণী জানান, আকতার ফারুকের সঙ্গে তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। প্রায়ই তাঁর মায়ের হাতে টাকা দিতেন ফারুক। মেয়েটিকে উপহার কিনে দিতেন। বিভিন্ন সময়ে সিবিএ নেতা হিসেবে তাঁর ক্ষমতার কথা বলতেন। মেয়েটির অভিযোগ, ২০১৯ সালের শেষ দিকে একা পেয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেন ফারুক। এ ঘটনার পর গ্রামে ফিরলে (২০২০ সালে) দু-তিন মাসের মধ্যে তাঁর গর্ভধারণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। মা প্রচণ্ড মারধর করলে ঘটনা খুলে বলেন তিনি। এরপর মা ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফারুক তাঁদের ঢাকায় চলে আসতে বলেন। ফারুকের উপস্থিতিতে ঢাকার শ্যামলীতে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেয়েটির গর্ভপাত করানো হয়। এ সময় ফারুক ধর্ষণের ঘটনার জন্য মেয়েটি ও তাঁর মায়ের কাছে ক্ষমা চান বলে জানান ভুক্তভোগী তরুণী। ওই সময় মেয়েটির বড় বোন বাসা বদলে মিরপুরে চলে আসেন। তখন মা-মেয়ে ওই বাসাতেই ওঠেন।

সন্তান জন্মদান, বিয়ে

তরুণী জানান, ওই ঘটনার পর তিনি প্রচণ্ড রকমের বিষণ্ন থাকতেন। ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ ছিল। সাত-আট মাস পর এক নারীর মাধ্যমে তিনি ঢাকায় বারে গান গাওয়া শুরু করেন। মোট তিনটি বারে গান গেয়েছেন। তাঁদের অনটনের সুযোগ নিয়ে ২০২২ সালে ফারুক আবার যোগাযোগ করেন। মেয়েটির অভিযোগ, বিয়ের কথা বলে তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করেন ফারুক। তবে বিয়ে নিয়ে টালবাহানা করছিলেন। প্রথম স্ত্রী আছে তাই নিবন্ধন ছাড়া কলেমা পড়ে বিয়ে করতে চান। তিনি বলতেন, সরকারি চাকরি করেন, জানাজানি হলে তাঁর সমস্যা হবে।

মেয়েটি জানান, তিনি আবার গর্ভধারণ করলে ঢাকার সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে যান গর্ভপাতের জন্য। কিন্তু চিকিৎসক তাঁর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে রাজি হননি। চিকিৎসক নৈতিক কিছু কথাও বলেন, যা শুনে তিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি তিনি অস্ত্রোপচারের (সি সেকশন) মাধ্যমে ছেলেসন্তানের জন্ম দেন।

মেয়েটি বলেন, এরপর কিছুদিন ফারুক খোঁজখবর রাখলেও পরে তা অনিয়মিত হয়ে যায়। এ নিয়ে কলহে ফারুক তাঁর বোনের বাসায় এসে তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন এবং তাঁর সন্তানকেও আঘাত করার চেষ্টা করেন। বিয়ের কোনো কাবিননামা না থাকলেও ফারুক তাঁকে তালাকের নোটিশ পাঠান।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আকতার ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ধর্ষণ ও গর্ভপাতের অভিযোগ একেবারেই মিথ্যা। ২০২১ সালে বাসায় হুজুর ডেকে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। বর্তমানে তাঁর এই স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বোনের বাসায় থাকেন। তিনি খরচ পাঠিয়ে দেন।

তালাকের নোটিশ পাঠানোর কথা উল্লেখ করে আকতার ফারুক বলেন, ‘স্বভাব ভালো না হওয়ায়’ এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বারবার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করায় এ বছর তিনি তাঁকে তালাক পাঠিয়েছেন। বিয়ে নিবন্ধন না হলে তালাক কীভাবে হয়, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শরিয়াহ আইনে হয়।

তবে বাসায় হুজুর ডেকে বিয়ে পড়ানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে ওই তরুণী জানিয়েছেন।

সংসদ সদস্যের নির্দেশে বিয়ে

ভুক্তভোগী তরুণী জানান, ঢাকার মিরপুরের ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করার পর এ বছর ৫ রমজানের দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য তাঁর বাসায় অবস্থিত কার্যালয়ে কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা নেন।

মেয়েটির অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েটি আমার কাছে এসেছিল। পুরো ঘটনা শুনে আমার মনে হয়েছে, এটা একটা ভয়াবহ নারী নির্যাতনের ঘটনা। লোকটির সঙ্গে মেয়েটির বয়সের অনেক ফারাক। তিনি আরেকটি মেয়ের সঙ্গেও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত বলে শুনেছি। আমি পুরো ঘটনাটি সংসদ সদস্যকে জানাই এবং মেয়েটিকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।’

ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. মাইনুল হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আকতার ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর দেখলাম, বিয়েটি নিবন্ধন করা নেই। তাই আমার অফিসেই কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করি। এরপর আর কী হয়েছে, জানি না। এরপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে মেয়েটি ও তাঁর শিশুসন্তানের সুরক্ষায় আইনি ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করা হবে।’

এ ঘটনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (তদন্ত) মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, আকতার ফারুকের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তাঁর কাছে মৌখিকভাবে করেছিলেন মেয়েটি। তখন মেয়েটিকে বলেছিলেন লিখিত অভিযোগ দিতে। ওই সময় তিনি ঢাকা কার্যালয়কে ঘটনাটি অবহিত করেন এবং মৌখিকভাবে আকতার ফারুককে সতর্ক করা হয়। তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে আচরণ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সাধারণত নেওয়া হয় না। তবে স্ত্রী কোনো মামলা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আকতার ফারুকের পেনশনের টাকার অংশ সন্তানের নামে নিতে আলাদা করে আবেদন করতে পারেন।

এদিকে দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণে সহযোগিতা চেয়ে মেয়েটি বলেন, ‘কষ্টে কষ্টেই আমরা বড় হলাম। কোনো সম্মানের জীবন পাইনি। সমাজের সবাই একটু পাশে দাঁড়ালে আমার সন্তান একটি সুস্থ পরিবেশে বড় হতে পারবে।’