সাত আন্তর্জাতিক সংগঠনের যৌথ বিবৃতি
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের ওপর হামলা
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্বনামধন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে সহিংস হামলা এবং বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটে ভাঙচুরের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে সাতটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। সংগঠনগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), অনলাইনে নাগরিক অধিকার রক্ষায় কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন অ্যাকসেস নাউ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিন, সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি), জার্নালিস্ট ফর ডেমোক্রেসি ইন শ্রীলঙ্কা (জেডিএস) ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (টিজিআই)।
১৮ ডিসেম্বর এসব প্রতিষ্ঠানে হামলার কথা উল্লেখ করে সোমবার এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দৃশ্যত এসব সমন্বিত সহিংস কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে স্বাধীন গণমাধ্যম, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও সাংস্কৃতিক পরিসরের বিরুদ্ধে হামলা গুরুতরভাবে বৃদ্ধির বিষয়টিকে তুলে ধরেছে। একই রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা ও পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর পর এসব ঘটনা ঘটে। ১২ ডিসেম্বর দেশটির রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে ওসমান হাদিকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা, ১৮ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
বিবৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বলেছে, রাজনীতিবিদ, অধিকারকর্মী, শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা, বিশেষত ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে যখন রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সময়ে আইনের শাসনের অবক্ষয় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক আলোচনা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের জায়গাগুলো সংকুচিত হয়ে আসা গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
‘আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন, যাচাইকৃত খবরগুলো এই আভাস দিচ্ছে যে দুটি সংবাদমাধ্যমের জ্বলন্ত প্রাঙ্গণের (ভবনে) মধ্যে সাংবাদিক ও কর্মীরা আটকা পড়েছিলেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকির মুখে পড়েছিলেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রুত ও কার্যকরভাবে সাড়া প্রদানে যেকোনো ব্যর্থতা নাগরিকদের জীবন রক্ষার রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। তার ওপর সংবাদপত্রগুলোর ছাপা ও অনলাইন সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়াটা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের জগতে একটি নজিরবিহীন বিঘ্নের ঘটনা এবং এটা স্বাধীন সাংবাদিকতা যে হুমকির মুখে পড়েছিল তার তীব্রতাকে তুলে ধরে। তা ছাড়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের হয়রানি ও শারীরিক আঘাতের ভয় দেখানোটা যারা রাষ্ট্রের কার্যকর সুরক্ষার অনুপস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে চায় তাদের বেপরোয়া ভাব বাড়তে থাকার বিষয়টিকে তুলে ধরে।’
ছায়ানটের ওপর হামলা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতি বৈরিতার একটি বৃহত্তর ধারার ইঙ্গিত দেয়, যা শিল্পীসত্তার প্রকাশ ও মতের বৈচিত্র্যের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ পরিবেশকে উন্মোচিত করে। এসব ঘটনা অনলাইন ও অফলাইন সহিংসতার একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকেই ইঙ্গিত করে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পরিকল্পিত হয়রানি এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত নজরদারির চর্চা, যা দায়মুক্তির একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। এ বছরজুড়ে আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহার করে চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এবং বাউল, সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী ও শিল্পীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং তাঁদের ওপর হামলার একটি ধারা দেখা গেছে।
এসব হামলার একটি অংশ ঘটেছে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতার আহ্বান থেকে, যেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বড় সংখ্যায় অনুসারী রয়েছে এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি অনলাইনে পোস্ট করেছেন বলে মনে হচ্ছে। ওই সব বক্তব্য ও সহিংসতার আহ্বান পরবর্তী সময়ে তাঁদের অনুসারী ও নেটওয়ার্কগুলো আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। এ ধরনের ঘৃণামূলক কনটেন্টের (আধেয়) অব্যাহত প্রচার প্রযুক্তি খাতের মানবাধিকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
এই ঘটনাগুলো অনলাইনে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতায় উসকানির বিষয়ে রাষ্ট্রের দ্রুত ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থতার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তোলে, যেখানে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতায় লোক জড়ো করার প্রমাণ এবং এর পুনরাবৃত্তির নজির রয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদসহ (আইসিসিপিআর) আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি বাংলাদেশের বাধ্যতামূলক দায়বদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি সংবিধানেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ও নাগরিক অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এসব দায়বদ্ধতা রাষ্ট্র ও অরাষ্ট্রীয় উভয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ, সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ঘটনার তদন্ত করা, দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার দিতে যুক্তিসংগত সবকিছু করতে রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
এসব ব্যর্থতাকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে। ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার কথা বলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষগুলো জনগণের বিক্ষোভ মোকাবিলায় অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, ব্যাপক দমন–পীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো কার্যক্রম চালায়। আজ সেখানে বিপরীতভাবে অন্তর্বর্তী সরকার কাউকে টার্গেট করে পরিচালিত সহিংসতা, বিদ্বেষমূলক উসকানি এবং নাগরিকদের জীবনের ওপর বিশ্বাসযোগ্য হুমকির মুখেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক নয় বা তারা সক্ষম নয় মনে হচ্ছে।
এ দুটোই চরম পর্যায়ের—একদিকে দমননীতি, অন্যদিকে নিষ্ক্রিয়তা—এর কোনোটিই বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীন থাকা দায়বদ্ধতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিরোধী মতকে চেপে রাখা বা কর্তব্য থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়া নয়, বরং আইনানুগ, পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নিয়ে নাগরিকদের জীবন, অধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিসর সুরক্ষিত করা। আর এগুলো হতে হবে সরকারের যে ম্যান্ডেট রয়েছে এবং যেসব প্রতিশ্রুতি তারা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছে, সেগুলোর আলোকে। এটা করতে ব্যর্থ হলে দায়মুক্তির ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়া এবং বর্তমান প্রশাসন এবং ভবিষ্যতের প্রশাসনের জন্যই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নিচের আহ্বানগুলো জানিয়েছে:
# অবিলম্বে সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি যেখানে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি রয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
# প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ছায়ানটের হামলার পাশাপাশি অন্যান্য সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী ও শিল্পীদের ওপর হামলার ঘটনার দ্রুত, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। একই সঙ্গে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সব অপরাধী, অপরাধের পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং ভুক্তভোগী অথবা তার নিকটাত্মীয়দের কার্যকর প্রতিকার পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
# বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ও সহিংসতায় উসকানি এবং সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে এমন ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে আগাম ব্যবস্থা, পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ ও সময়োচিত হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করার জন্য প্রযুক্তি কোম্পানি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের সময় (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের) গ্রাহকদের নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে।
# প্রকাশ্যে ও দ্ব্যর্থহীনভাবে সাংবাদিক, গণমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানির নিন্দা জানাতে হবে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক পরিসরের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে হবে।
# অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং নাগরিক অংশগ্রহণের জন্য একটি নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে তা করতেই হবে।
# মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধান ও আইসিসিপিআরসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অঙ্গীকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে জাতীয় আইন, নীতি ও চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
# আমরা বাংলাদেশের সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, শিল্পী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি এবং অফলাইন ও অনলাইন—উভয় ক্ষেত্রে নাগরিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে সবার অংশগ্রহণের অধিকারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।