অপরাধী চক্রটিকে তথ্য দিতেন মোবাইল কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার

পারভিন আক্তার নুপুর

বয়স্ক মানুষের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ দিয়ে শুরু। এরপর বিভিন্ন অজুহাতে ফোনালাপ, কখনো প্রয়োজন দেখিয়ে সাক্ষাৎ। হৃদ্যতা বেড়ে গেলে তো কথাই নেই। ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বা গোপন কথার রেকর্ড জমাতেন মুঠোফোনে। এরপর শুরু হতো ব্ল্যাকমেল। কেউ ২ লাখ, কেউবা ২০ লাখ টাকা দিয়ে নিস্তার পান।

পরিকল্পিতভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার এমন একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে হাতিরঝিল থানা-পুলিশ। এ কাজে তাদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন একটি মুঠোফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার। সিম নিবন্ধনে ব্যবহৃত যেকোনো ব্যক্তির তথ্য প্রয়োজন অনুসারে চক্রটিকে সরবরাহ করতেন তিনি।

শেফালী বেগম

পুলিশের তথ্যানুযায়ী চক্রের প্রধান পারভীন আক্তার ওরফে নুপুর (২৮), তাঁর বড় বোন শেফালী বেগম (৪০), মতিঝিলের পারফেক্ট ট্রাভেল এজেন্সির কর্মচারী শামসুদ্দোহা খান ওরফে বাবু (৪০) এবং মুঠোফোন কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার রুবেল মাহমুদ অনিক (২৭)।

৩ ডিসেম্বর হাতিরঝিল থানায় মো. নাসের খান (৬৫) নামে এক ব্যক্তির মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ৩, ৪ ও ৬ ডিসেম্বর মোহম্মদপুর, নিকেতন, রমনা ও বাড্ডা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পারভীন ও অনিককে তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

ব্ল্যাকমেলের শিকার ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক এবং উচ্চ বেতনধারীরা
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার হাফিজ আল ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ৬০ বা তদূর্ধ্ব বয়সী বিভিন্ন পেশার মানুষকে এরা টার্গেট করে। অন্তত ২০ জনকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করার কথা স্বীকার করেছে। এর মধ্যে ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক এবং উচ্চ বেতনধারী বেসরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা নিয়েছে।

ফোনের রেকর্ড পরিচিতজনদের মাঝে পাঠিয়ে অপদস্থের হুমকি

শামসুদ্দোহা খান বাবু

তদন্ত কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার শামসুদ্দোহা খান বাবু ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করার সুবাদে নিয়মিত বিদেশগামী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পদস্থ চাকরিজীবীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে পারভীন আক্তারকে দিতেন। পারভীন নিজেকে কখনো সমাজকর্মী হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে, কখনো চাকরির প্রার্থী বা সাংবাদিক পরিচয়ে এসব ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতেন। নানা অজুহাতে মুঠোফোনে কথা বলতেন, ব্যক্তিবিশেষে যা ৩-৪ মাস পর্যন্ত গড়াত। এই সময়ে স্পর্শকাতর বা গোপন কথাবার্তা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতেন।

এরপর এই তথ্য সেই ব্যক্তির পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজনদের জানিয়ে সামাজিকভাবে অপদস্থ করার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন পারভীন। এই টাকার পরিমাণ ব্যক্তিভেদে ৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে পারভীনের বড় বোন শেফালী বেগম দৃশ্যপটে হাজির হতেন। ফোন করে মামলার হুমকি দিতেন।

সাহায্য করতেন মোবাইল কোম্পানির কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার

রুবেল মাহমুদ অনিক

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, মামলার হুমকি পেয়ে অনেকেই মানসম্মানের ভয়ে দাবিকৃত টাকা দিয়ে দিতেন। তবে তারপরও কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার রুবেল মাহমুদ অনিকের কাছ থেকে সেই ব্যক্তির সিমের নিবন্ধন–সংক্রান্ত তথ্য (নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, জন্মনিবন্ধন নম্বর ইত্যাদি) সংগ্রহ করতেন। এরপর আইনজীবী পরিচয়দানকারী ইসা নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে পূর্বনির্ধারিত ফরমেট অনুযায়ী অভিযোগ লিখিয়ে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন মামলা করার হুমকি দেওয়া হতো। মামলাগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিগ্রাহ্য করতে মিথ্যা ও বানোয়াট বিল–ভাউচার তৈরি করা হতো। সেখানে দেখানো হতো টার্গেটকৃত ব্যক্তি পারভীনকে স্ত্রী বা মেয়েবন্ধু হিসেবে বিভিন্ন উপহার দিয়েছেন। এমনকি শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নামকরা চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে চিকিৎসাপত্রে ‘স্বামীর নাম’ অপশনে টার্গেটকৃত ব্যক্তির নামও লিখতেন পারভীন। এসব প্রমাণাদি মামলায় ব্যবহারের হুমকি দিতেন তিনি।

৭-৮ জন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন

তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই এই চক্রের সদস্যদের দাবিকৃত টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। লজ্জায় অনেকেই অভিযোগ করতে চান না। ৭-৮ জন আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই চক্রকে সমূলে উৎপাটনের পাশাপাশি এদের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, মুঠোফোন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত একজন কর্মকর্তা ব্ল্যাকমেল চক্রের সদস্য হিসেবে টাকার বিনিময়ে যেভাবে সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত একান্ত গোপনীয় তথ্যগুলো পাচার করেছেন, সেখানে মোবাইল অপারেটরের কী গাফিলতি আছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।