অস্ত্রধারী ১০ জন শনাক্ত, গ্রেপ্তার হননি একজনও

শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষের একপর্যায়ে নাহিদ হোসেনকে কোপাতে দেখা যায়। গত মঙ্গলবার দুপুরে।
ছবি: ডেইলি স্টার

নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো ১০ জনকে এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৫ জন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। সংঘর্ষের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ দেখে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে।

তবে ঘটনার ছয় দিন পরও ১০ জনের কাউকেই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁদের মধ্যে পাঁচজন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন বলে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।

১৯ এপ্রিলের ওই সংঘর্ষের সময় নাহিদের পাশাপাশি পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় দোকানকর্মী মোহাম্মদ মোরসালিনকে। তাঁকে কারা পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছেন—এ বিষয়ে এখনো তদন্তে সুনির্দিষ্ট কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেনি পুলিশ। হামলাকারীদেরও শনাক্ত করা যায়নি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত করা আহ্বায়ক কমিটির এক নেতার অনুসারীরা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও ছবি বিশ্লেষণের পাশাপাশি নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সূত্র বলছে, সংঘর্ষের সময় ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির চার নেতার অনুসারীরা বেশি বেপরোয়া ছিলেন। তাঁদের অনেকে হেলমেট পরে ধারালো অস্ত্র এবং রড–পাইপ হাতে ভাঙচুর–সহিংসতায় অংশ নেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মোরসালিন হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত, সে বিষয়ে জানতে ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁদের দেওয়া তথ্য যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি সংঘর্ষ, ভাঙচুর–সহিংসতার ঘটনায় ব্যবসায়ী-দোকানকর্মীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। শিগগিরই এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে।

দুটি হত্যা মামলার তদন্তের পাশাপাশি সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের শনাক্তেও কাজ করছে ডিবির একাধিক টিম। এরই মধ্যে অন্তত ১০ অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাঁরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ডিবি সূত্র বলেছে, সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে এবং ধারালো অস্ত্র হাতে শুধু ছাত্ররা নন, ব্যবসায়ী-দোকানকর্মী ও হকাররাও অংশ নেন। তাঁদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে।

বাশার ইমন

উল্লেখ্য, ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। নিউমার্কেটের দুটি খাবারের দোকানের দুই কর্মীর বিতণ্ডা থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত। এর জের ধরে ১৯ এপ্রিল (গত মঙ্গলবার) দিনভর রাজধানীর মিরপুর সড়কের নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকানমালিক-কর্মচারী ও হকারদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে মারা গেছেন দুজন। আহত হয়েছেন অর্ধশত ব্যক্তি। এ ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা দুটি। আর চার মামলায় মোট আসামি ১ হাজার ৫৭৪ জন। এর মধ্যে নাম উল্লেখ করা আসামি ২৪ জন, অন্যরা অজ্ঞাতপরিচয়।

এখন পর্যন্ত পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনায় করা মামলায় শুধু নিউমার্কেট থানা বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাঁর তিন দিনের রিমান্ড আজ মঙ্গলবার শেষ হবে। রিমান্ডে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে কী তথ্য পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি পুলিশ।

আতঙ্কে ক্যাম্পাস ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা

ডিবি ও র‌্যাবের পৃথক দল গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে অভিযান চালায়। সেখান থেকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সদস্য জহির হাসান ওরফে জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। পরে ওই রাতেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

যে কক্ষে অভিযান চালানো হয়েছিল, সেই কক্ষে বাশার ইমন থাকতেন। সংঘর্ষের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ইমন হেলমেট পরে ধারালো অস্ত্র হাতে নাহিদকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করছেন। ডিবি ও র‌্যাবের অভিযানের সময় ইমন তাঁর কক্ষে ছিলেন না। তাঁর মুঠোফোনও দুই দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

গত রোববারের অভিযানের পর আতঙ্কে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাস ছাড়তে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। কলেজের আটটি ছাত্রাবাস এখন প্রায় ফাঁকা। সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে ধারালো অস্ত্র হাতে ভাঙচুর–সহিংসতায় অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন ছাত্রের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই অনেক শিক্ষার্থী ছাত্রাবাস ছেড়ে যান।

এদিকে রোববার রাতে ছাত্রাবাসে অভিযানের বিষয়ে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আলামত উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রাবাসে গিয়েছিল। সেটি কোনো অভিযান ছিল না। ফেরার সময় তারা এক ছাত্রকে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাতে তাঁকে ছেড়ে দেয়। অনুমতি নিয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাত্রাবাসে গিয়েছিল।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, তার তদন্ত পুলিশ করবে। কেউ সহিংসতায় জড়িত থাকলে তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিলে কলেজের কিছু বলার থাকবে না। তবে নিরীহ ছাত্ররা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন বা হয়রানির শিকার না হন, সেটি কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখবে।