অস্ত্রসহ ধরা, গণপিটুনি, তবু ছাড়া পান দেলোয়ার

২০১৮ সালের শেষ দিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী দক্ষিণ বাজারে অস্ত্র, গুলিসহ হাতেনাতে আটক করে দেলোয়ারকে গণপিটুনি দেন লোকজন। পরে তাঁকে থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু ওই ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি
ছবি: সংগৃহীত

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন (২৬) বছর দুই আগে অস্ত্র, গুলিসহ জনতার হাতে ধরা পড়েছিলেন। তখন তাঁকে পিটুনি দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই বীরদর্পে এলাকায় ফিরে আসেন তিনি।

এ ছাড়া একটি জোড়া খুনে এবং নিজের বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় কারাগারেই যেতে হয়নি দেলোয়ারকে। তাঁকে মামলায় আসামিও করা হয়নি। উল্টো তাঁর বাড়িতে অস্ত্র থাকার খবরদাতাকেই গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। সর্বশেষ এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর ৫ অক্টোবর দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এখন তাঁর নানা অপকর্মের ঘটনা সামনে আসছে।

এলাকাবাসী জানান, ২০১৮ সালের শেষ দিকে চৌমুহনী দক্ষিণ বাজারের নুরুল হক মিয়ার রাইস মিল এলাকায় দেলোয়ার একটি শটগান, দুটি গুলিসহ জনতার হাতে ধরা পড়েছিলেন। মারধরের পর তাঁকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ তাঁকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ঘটনায় দেলোয়ারের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা হয়নি। উদ্ধার করা অস্ত্রেরও হদিস নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেগমগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ হারুন অর রশিদ চৌধুরী গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, দেলোয়ার কখনো অস্ত্রসহ আটক হয়েছেন কি না, তা তিনি জানেন না। তবে একটি হত্যা ও একটি মারামারির মামলার পলাতক আসামি হিসেবে তিনি দেলোয়ারকে গ্রেপ্তারের জন্য একাধিকবার অভিযান চালিয়েও সফল হননি।

অভিযোগ উঠেছে, দুই বছর আগে দেলোয়ারের অস্ত্র-গুলিসহ আটকের বিষয়টি তখন পুলিশ ধামাচাপা দিয়েছিল সাংসদ মামুনুর রশীদের লোকজনের তদবিরে। স্থানীয় লোকজন জানান, গণপিটুনিতে আহত দেলোয়ারকে তখন সাংসদের লোকজন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। পরে সুস্থ হয়ে এলাকায় ফিরে দেলোয়ার আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

তবে সাংসদ মামুনুর রশীদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি দেলোয়ারকে চেনেন না। কখনো দেখেছেন বলেও তাঁর মনে পড়ছে না। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে দেলোয়ারকে জড়িয়ে তাঁর নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার

দেলোয়ারের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পূর্ব একলাশপুর গ্রামে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ তাঁর বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে একটি দেশি বন্দুক (এলজি) ও তিনটি কার্তুজ উদ্ধার করে। তখন দেলোয়ার বাড়িতে ছিলেন না। দেলোয়ারের বড় ভাই আনোয়ার হোসেন ও ভাবি সুইটি আক্তারের উপস্থিতিতে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। জব্দ তালিকায় সাক্ষী হিসেবে তাঁদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর রয়েছে ডিবির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল হাদি ও তাঁদের গাড়ি চালক আবুল হোসেনেরও।

কিন্তু এ ঘটনায় ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রেজাউল করিম বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ থানায় যে মামলা করেন, তাতে দেলোয়ারকে আসামি করা হয়নি। উল্টো তথ্যদাতা একই বাড়ির আবদুল হান্নান ও পাশের গ্রামের যুবদল কর্মী মো. হাবিবুর রহমানকে আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁরা জামিন পান।

হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল দেলোয়ারের বাড়ি থেকে। অথচ পুলিশ দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, মামলায় আসামিই করেনি।

দেলোয়ারের বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আসামি করা হয় তথ্যদাতাকে। হত্যা মামলা থেকেও বাদ। সহায়তার অভিযোগ সাংসদের বিরুদ্ধে।

জোড়া খুন থেকেও রেহাই

দেলোয়ার হোসেন

জোড়া খুনের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালের ১০ মার্চ। ওই দিন ভোরে একলাশপুর গ্রামে মোহাম্মদ আলী ও আবদুর রহিম নামের দুই যুবককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁরা যথাক্রমে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওই ঘটনার পর নিহত মোহাম্মদ আলীর ভাই সরাফত আলী বেগমগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলাটির এজাহার সংগ্রহ করে দেখা গেছে, স্থানীয় একটি বাহিনীর প্রধান মো. সুমন ওরফে খালাসি সুমনসহ ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

বাদী সরাফত আলী গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যে অভিযোগ দিয়েছিলেন, তাতে আসামিদের মধ্যে দেলোয়ারের নামও ছিল। কিন্তু পুলিশ দেলোয়ারের নাম বাদ দিয়ে মামলাটি নিয়েছে।

সরাফত আলী জানান, পুলিশ মামলা থেকে দেলোয়ারের নাম বাদ দেওয়ায় তিনি দেলোয়ারসহ পাঁচজনকে আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে ওই বছরের ২৮ মে আদালতে আবেদন করেন। আদালত তদন্তের দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। কিন্তু পিবিআই অভিযোগপত্রে দেলোয়ারকে আসামি করেনি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের (নোয়াখালী) পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম দাবি করেন, বাদী মামলার তদন্তে সহযোগিতা করেননি। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

অস্ত্রসহ জনতার হাতে ধরা পড়া, মামলায় আসামি না হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রসহ জনতার হাতে ধরা পড়ার পর মামলা হবে না, কিংবা বাদী অভিযোগ করার পর মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত হবে না, পুলিশ এতটা অপেশাদার আচরণ করেছে বলে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। পুলিশ সুপার বলেন, এখন যেহেতু দেলোয়ারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা হয়েছে, তাঁর অতীতের সবকিছুই খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অপরাধের বিষয়েই ছাড় দেওয়া হবে না।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তদবির উপেক্ষা করতে পারে না। দেলোয়ারের ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নোয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রাছুল প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধ করে হাতেনাতে দেলোয়ারের মতো দুর্বৃত্তরা ধরা পড়ার পরও পার পেয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে তাঁরা আরও বড় অপরাধ করার সাহস পান।