উচ্ছেদের বদলে ফুটপাতের দখল কাউন্সিলরদের

দায়িত্ব নিয়েই রাজধানীর ফুটপাতগুলো নিজেদের দখলে নিয়েছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। অথচ সাড়ে চার মাস আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় তাঁরাই ফুটপাত দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন জমিজমা-সংক্রান্ত সালিস-মীমাংসার কাজেও তাঁদের উৎসাহ দেখা যায়। তবে নাগরিকত্ব সনদ দেওয়াসহ আরও কিছু কাজে সাধারণ নাগরিকেরা খুশি।
তিন দিন প্রথম আলোর পাঁচজন প্রতিবেদক রাজধানীর অন্তত ২০টি ওয়ার্ড ঘুরে এ রকম একটা চিত্র পেয়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নিউমার্কেট, পুরান ঢাকা, গুলিস্তান, গুলশান ও বনানী। এর মধ্যে অন্তত ১২টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক গতকাল রোববার রাজধানীতে এক গোলটেবিল আলোচনায় বলেন, ‘সবাই বলেন, ফুটপাত থেকে হকার তুলে দেন, রাস্তা দখলমুক্ত করেন। কিন্তু এটা তত সহজ নয়। তাঁরা টাকা দিয়ে বসেছেন। শক্ত শক্ত হাত এর পেছনে আছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে কাউন্সিলরদের কাজ বা দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে, একজন কাউন্সিলর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভা ও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তাদের সহায়তায় তাঁরা এলাকার উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পেশ করতে পারবেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বেতনের বিলে সই করার অধিকার আছে তাঁর। এ ছাড়া নাগরিকত্ব, চারিত্রিক ও জন্মসনদ দিতে পারেন।
হকার সমিতিগুলোর হিসাবে, ঢাকায় প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার হকার আছেন। এর মধ্যে দেড় লাখ হকার ফুটপাতে বসেন। ২৫ হাজার রাস্তায় দোকানদারি করেন। আর ২৫ হাজার মৌসুমি হকার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরপরই রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদ এসেছে। ফলে মৌসুমি হকারের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাকি হকাররা গণপরিবহন, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নানা পণ্য বিক্রি করে থাকেন।
এসব হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন স্থানভেদে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। ঈদ কিংবা উৎসবে এই চাঁদার হার আরও বেড়ে যায়। প্রতি হকারের কাছ থেকে গড়ে ১০০ টাকা করে দৈনিক মোট ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা ওঠে। বছরে এর পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকার বেশি। রমরমা এই চাঁদাবাজির কারণেই সকালে হকার উচ্ছেদ করলে বিকেলে পুনরায় বসে যায়।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাসেম বলেন, সম্প্রতি চাঁদাবাজদের তালিকা দেওয়ার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সিটি করপোরেশনকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে রাজস্বের বিনিময়ে হকারদের নিবন্ধন দিতে। তাহলে বাইরের চাঁদাবাজি বন্ধ হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছিল। ২০১১ সালে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ হয়ে যায় ঢাকা। গত এপ্রিলে হয় দুই সিটির নির্বাচন।
ফুটপাতের ব্যবসা: কোরবানির ঈদ তিন দিন পরেই। আর বরাবরই উৎসবের আগে ফুটপাতের ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। গত শনিবার মতিঝিলে গিয়ে দেখা যায় হকারদের মন ভার। কারণ, বৃষ্টিতে দিনের ব্যবসা অনেকটাই ভেসে গেছে। এক হকার বলেন, ‘আইজ মনে হয় খরচই উঠব না। চাঁদা, খাওয়া-দাওয়া এবং সহকারীর বেতন মিলে হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়।’
টিকাটুলিতে রাজধানী সুপার মার্কেটে দোকান আছে ১ হাজার ৭৮৮টি। মার্কেটের ফটক ও সামনের ফুটপাতে বসেন শতাধিক হকার। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মঞ্জুর নেতৃত্বে চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে দোকানমালিকেরা র্যাব-পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন গত রোজার সময়। এরপর র্যাব-১০-এর একটি দল অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ১১ জনকে চাঁদার টাকাসহ হাতেনাতে ধরে। ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিমকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনার পর কাউন্সিলর ময়নুল হক গা ঢাকা দেন বলে র্যাব জানায়। আর রেজাউলকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ময়নুল হক রাজধানী সুপার মার্কেটের স্বঘোষিত সভাপতি ও রেজাউল সাধারণ সম্পাদক। ময়নুল হক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো সব ভুয়া কথা।’
মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বরে মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে জুতা, স্যান্ডেল ও জামাকাপড়ের অন্তত ৫০টি দোকান আছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ১০০ টাকা চাঁদা তোলা হয় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী টিপু সুলতানের নামে। কাউন্সিলরের অনুসারীরা চাঁদা তোলার দায়িত্বে। দোকানিরা বলেন, সিটি নির্বাচনের পর থেকেই কাউন্সিলরের নামে এভাবে চাঁদা তোলা হচ্ছে। গত সপ্তাহে ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলার সময় শাহ আলী থানার পুলিশ এমন এক অনুসারী মোল্লা সুমনকে হাতেনাতে আটক করে।
এ বিষয়ে কাজী টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি বলি সুমনকে চিনি না, ভুল বলা হবে। আমিও এলাকায় থাকি, সেও আমার এলাকায় থাকে। আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদা নিতে পারে, তা তো আমি জানি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা আছে চাঁদাবাজি করতে এলেই ধরে নিয়ে যেতে।’
ফুটপাতে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু মিরপুর-১০ নম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৪-এর মূল ফটক ও সীমানা দেয়াল ঘেঁষে শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে। পানি নিষ্কাশনের নালার ওপরে বাঁশের মাচা দিয়ে বানানো এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে প্যান্ট, শার্ট, জুতা। দোকানিদের ফেলা পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে নালা।
দোকানিরা জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারী ও স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলামের অনুসারীরা নিয়মিত চাঁদা তোলেন। এ ব্যাপারে কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এপ্রিলে সিটি নির্বাচনের পর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের সীমানাদেয়াল ঘেঁষে বাঁশ, কাঠ, ত্রিপল দিয়ে ছোট মার্কেটের মতো গড়ে উঠেছে। সেখানে বিক্রি হচ্ছে শাড়ি, জামাকাপড়, স্যান্ডেল ও কসমেটিকস। অন্তত পাঁচজন দোকানদার বললেন, স্থানীয় ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের নামে এখান থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয়।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর তারেকুজ্জমান রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বারবার দোকানগুলো উচ্ছেদ করে দিই বলে তাঁরা আমার নাম বলতে পারে। তাঁরা কাকে টাকা দেয়, কে নেয় আমার জানা নেই। পিকআপ স্ট্যান্ড তো কয়েক দিন আগেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।’
একই অবস্থা রাজধানীর গুলিস্তান, নিউমার্কেট, গাউছিয়া এলাকায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের গুরুত্ব অনেক। সেগুনবাগিচা, তোপখানা রোড, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও রেস্ট হাউস, টিবি ক্লিনিক এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকা, ফুলবাড়িয়া, আনন্দবাজার এলাকা পড়েছে এই ওয়ার্ডে। এখানে ফুটপাত উপচে রাস্তায়ও দোকান বসে। গত তিন মাসে মেয়র ও কাউন্সিলররা শুধু গুলিস্তানের একটি রাস্তা থেকে চারবার হকার উচ্ছেদ করেছেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অনুসারীরা টাকা নিয়ে হকারদের বসার ব্যবস্থা করে দেন।
এ প্রসঙ্গে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সচিবালয়ে গেলে কর্মকর্তারা আমাকে ইজ্জত করেন। কারণ সচিবালয় আমার এলাকায় পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পোলাপানদের বলেছি, যে টাকা তোমরা তোল, সেটা বন্ধ করে দাও। আমি তোমাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করব।’ মাদক ব্যবসায় নিজের লোক জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে আমি ব্যর্থ হইছি।’
ঢাকার নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, গাউছিয়া, এলিফ্যান্ট রোড নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডটি। গুলিস্তানের মতো এই এলাকায়ও স্থায়ীভাবে বছরের পর বছর দখল হয়ে আছে ফুটপাত। ঈদ সামনে রেখে নতুন করে নিউমার্কেটের ১, ২ ও ৩ নম্বর গেটের সামনে নতুন করে হকাররা বসেছেন। অভিযোগ আছে, স্থানীয় কাউন্সিলর ও নিউমার্কেট থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন আহমেদের অনুসারীরা নতুন দোকানগুলো বসিয়েছেন।
জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পলিথিন মুড়িয়ে ফুটপাতের ওপর দোকান একটা সংক্রামক ব্যাধি হয়ে গেছে। একদিকে হকার ওঠাই, আবার তারা এসে বসে পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের ঐকমত্য না থাকতে পারে, কিন্তু হকাররা বসামাত্রই তারা একজোট হয়ে যায়। ফলে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না। থানা সভাপতি হওয়ার কারণে অনেক কর্মী সেখানে থাকতে পারে।’
উত্তরের সবচেয়ে বড় ওয়ার্ড উত্তরার রাস্তা ও ফুটপাত হকারদের দখলে। স্থানীয় কাউন্সিলর আর পুলিশ চাঁদা নিয়ে হকারদের বসার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে এলাকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেছেন। এমনকি উত্তরা লেকের ওপর দখল করে দোকান উঠেছে। কাউন্সিলর হজে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর শাহনাজ পারভীন বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের লোকজন চাঁদা তোলেন কি না, তা তাঁর জানা নেই।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউন্সিলরদের মধ্যে অনেকের লক্ষ্য জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্বের মীমাংসা। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকায় ১৮টি পশুর হাট বসেছে। দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব হাটের অনেকগুলোর ইজারাদার কাউন্সিলরদের স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা। জোর করে গরুর ট্রাক নিজেদের হাটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
এবারের বর্ষায় বিভিন্ন ওয়ার্ডের রাস্তা ভেঙে গেছে। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে অনেক এলাকায়। এলাকার এসব রাস্তা ও নালা ঠিক করতে অনেক কাউন্সিলরই ১০ থেকে ৩০ কোটি টাকার পর্যন্ত বাজেট চেয়েছেন। দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত ৯৩ জন কাউন্সিলরের মধ্যে অন্তত ১৬ জন নিজেই ঠিকাদার। অনেকের বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নাগরিকদের সুবিধার্থে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করবে। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদা তোলা ক্রাইম। এটা হয়ে থাকলে বন্ধ করতে হবে। আর সালিস-মীমাংসা লাভালাভের চিন্তা থেকে করলে এর আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সাহায্য করেছেন অরূপ দত্ত, আনোয়ার হোসেন, আবদুর রশীদ, সামছুর রহমান ও মাহবুবুল হক ভূঁইয়া)