
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় স্থানীয় একটি কলেজকে জাতীয়করণের দাবিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন শিক্ষকসহ দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শিক্ষকসহ কমপক্ষে ২৫ জন।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, পুলিশের হামলায় আহত হয়ে শিক্ষক মারা গেছেন। আর অপর ব্যক্তি মারা গেছেন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে। তবে পুলিশের দাবি, শিক্ষক আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। আর অপর ব্যক্তি ঘটনাস্থলের কিছু দূরে মারা গেছেন। সেটা অন্য কারণে মারা যেতে পারেন।

গতকাল রোববার ফুলবাড়িয়া উপজেলা পরিষদের কাছে অবস্থিত ফুলবাড়িয়া কলেজকে ঘিরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবুল কালাম
আজাদ ফুলবাড়িয়া কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক। তিনি ময়মনসিংহ শহর থেকে আসা-যাওয়া করতেন। আর অপর নিহত সফর আলীর (৫৮) বাড়ি কুশমাইল কড়ইতলা গ্রামে। এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকার মানুষ গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন ধরিয়ে ময়মনসিংহ-ফুলবাড়িয়া রাস্তা বন্ধ করে দেন।
এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি জানান, সম্প্রতি সরকার ২৩টি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করে। এর মধ্যে সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা ফুলবাড়িয়া কলেজকে বাদ দিয়ে এমপিওবিহীন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজকে (ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। ফুলবাড়িয়া কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও এলাকার মানুষ বলছেন, সব দিক দিয়েই ফুলবাড়িয়া কলেজটি এগিয়ে থাকলেও তুলনামূলকভাবে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করায় তাঁরা ক্ষুব্ধ। এ নিয়ে তাঁরা প্রায় দেড় মাস ধরে আন্দোলন করছেন।
জানা গেছে, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ হাজার ৩০০ এবং এখানে সাতটি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। অন্যদিকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০০। ১৯৯৯ সালে কলেজটি সাংসদ মোসলেম উদ্দিনের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে কলেজটির নাম পাল্টে রাখা হয় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সাংসদের কারণেই ফুলবাড়িয়া কলেজটি জাতীয়করণ হয়নি—এই অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার উপজেলা সদরে সাংসদের একটি অনুষ্ঠানের আগে ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা। এ বিষয়ে সাংসদ মোসলেম উদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয়করণ নিয়ে তাঁর কোনো হাত নেই। তিনি তিনটি কলেজের নাম পাঠিয়ে ছিলেন। তার মধ্যে সরকার একটি কলেজকে নির্বাচন করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলেন, দেড় মাসের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল ছাত্র-শিক্ষকেরা কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি হিসেবে কলেজের ভেতর অবস্থান করছিলেন। কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দুপুরে মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় কলেজের ভেতর পুলিশ শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। তখন আরেক দল আন্দোলনকারী কলেজের ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তখন পুলিশ বাইরে অবস্থান করা মানুষদের ওপর টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কিছু দূরে গিয়ে জড়ো হন। তাঁরা পুলিশের টিয়ারশেলের জবাবে ইটপাটকেল ছোড়েন। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এভাবে কয়েক দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। পরে আরও পুলিশ আসে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় র্যাব সদস্যরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেন। অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, কলেজের ভেতর আহত শিক্ষকেরা অনেক সময় ধরে সেখানে আটকে ছিলেন। পরে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষক আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে তিনি মারা গেছেন। এতে আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। পরে পুলিশ উপজেলা পরিষদের দিকে চলে যায়। কিন্তু থেমে থেমে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে। এর মধ্যে খবর আসে সফর আলী নামের একজন মারা গেছেন। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তিনি মারা যান।
পুলিশের হামলা ও সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে দুই ব্যক্তির মারা যাওয়ার বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিফাত খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, যে শিক্ষক আহত হয়েছেন, তিনি আগে থেকেই হৃদ্রোগে ভুগছিলেন এবং ঘটনার আগে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর সফর আলী ঘটনার অদূরে অন্য কারণে মারা গেছেন। তাঁকে পুলিশই হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওসির দাবি, শিক্ষকদের ওপর পুলিশ হামলা করেনি। তবে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রথম আলোকে বলেন, সবার সামনেই পুলিশ কলেজের ভেতর ঢুকে হামলা করেছে।
আর কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ঘটনার সময় হাসপাতালে ছিলেন না। পরে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, ওই শিক্ষককে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে হাসপাতালে আনা হয় এবং তখন তাঁর বুকে ব্যথা ছিল। ইজিসি করার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় তিনি মারা যান।
এখনো থমথমে এলাকা: গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলা সদরে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকা থমথমে। কলেজের উত্তর দিকে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছেন। আর কলেজের দক্ষিণ দিকে উপজেলা পরিষদের সামনে অসংখ্য পুলিশ ও র্যাব সদস্য অবস্থান নিয়ে আছেন।

